যুক্তিটা মিসির আলির পছন্দ হচ্ছে না। ভাসা ভাসা যুক্তি। মনে হচ্ছে তিনি জলের উপর ওড়াউড়ি করছেন। জল স্পর্শ করতে পারছেন না।
বাইরে ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে
রাত দশটা।
বাইরে ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। মিসির আলি বাড়ির যে অংশে থাকেন তার বারান্দায় টিনের চালা। বৃষ্টির শব্দ সেই কারণেই স্পষ্ট। বাড়ির সঙ্গে কোনো বড় গাছ থাকলে গাছের পাতায় বৃষ্টি হতো। গাছের পাতায় পড়া বৃষ্টির শব্দও অদ্ভূত হয়। কিছুক্ষণ শুনলে নেশা ধরে যায়।
বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস হচ্ছে। বেশ ভালো বাতাস। বাতাসের জন্য বৃষ্টি পড়ার একটানা শব্দে হেরফের হচ্ছে। কখনো বাড়ছে, কখনো হঠাৎ করে মিলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কনসার্ট শুনছেন।
দুবার ইলেকট্রসিটি যাই যাই করেও যায় নি। এখন তৃতীয় বারের মতো যাই যাই করছে। ভোল্টেজ নেমে গেছে! একশ পাওয়ারের বালু থেকে দশ পাওয়ারের মতো আলো আসছে। মিসির আলি তাকিয়ে আছেন বাম্বের দিকে। বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির শব্দ যেমন ওঠা-নমা করছে, বাম্বের আলোও ওঠা-নামা করছে। বালের কাছেই পেটমোটা একটা টিকটিকি। সে শিকার ধরার চেষ্টা করছে! বাল্লের আলোর ওঠা-নামার কারণে তার মনে হয় বেশ অসুবিধা হচ্ছে। সে ঠিকমতো নিশানা করতে পারছে না। শিকার আটকাতে পারছে না। নিম্নশ্রেণীর কীটপতঙ্গরা ব্ৰাণনির্ভর জীবনযাপন করে। আলোর ওঠা-নমায় টিকটিকির অসুবিধা হবে কেন? সে ভরসা করবে তার ঘ্রাণশক্তির উপর। মিসির আলি বালু থেকে তার দৃষ্টি পুরোপুরি টিকটিকিটার উপর নিয়ে এলেন। বেশ উত্তেজনাময় দৃশ্য। টিকটিকিটা পোকা নিয়ে খেলছে না পোকা টিকটিকি নিয়ে খেলছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। পোকাটা উড়তে পারে। তার উচিত উড়ে গিয়ে নিরাপদ কোনো জায়গায় গিয়ে বসা। সে তা করছে না। আলোর পাশেই ওড়াউড়ি করছে। সে কি জানে আলোর প্রতি এই তীব্র আকর্ষণের কারণেই তার মৃত্যু হবে! মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আলোর মায়া সে ত্যাগ করতে পারছে না।
মানুষ কীটপতঙ্গ নয় বলেই তার চিন্তাভাবনা অন্য রকম। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সে অন্ধকারের মায়া ত্যাগ করতে পারে মা। মানুষ কি ভালবাসে অন্ধকার। কীটপতঙ্গ আলো ভালবাসে।
মিসির আলির ভুরু কুঞ্চিত হল। তাঁর হঠাৎ করে কেন যেন মনে হল মানুষ অন্ধকার ভালবাসে। মানুষ আলোর সন্তান। সে সব সময় আলো ভালবেসেছে। অন্ধকার ভালবেসেছে এমন মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য।
বাল্ব্বের পাশে পোকাটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। খাদক জয়লাভ করেছে খাদ্য পরাজিত। মিসির আলি চিন্তিত বোধ করছেন। এরকম বৃষ্টি আরো ঘণ্টাখানেক হলে ঘরে পানি ঢুকে যাবে। নর্দমার দুর্গন্ধ পানি একসময় নেমে যাবে কিন্তু গন্ধ থেকে যাবে।
দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে। মিসির আলি কে? বলে চিৎকার দিলেন না। কারণ দরজা কে খটখট করছে তিনি জানেন। বাড়িওয়ালা! এই ভদ্রলোক কড়া নাড়েন না-কড় ধরে হ্যাচক টান দেন। কড়া খুলে আনতে চান। হ্যাচকা টান দিয়ে কড়া নাড়তে তিনি আগে কাউকে দেখেন নি।
মিসির আলি দরজা খুলে বিস্মিত হয়ে বললেন, কী ব্যাপার?
আজমল সাহেবব মাথায় ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, আপনার টেলিফোন। খুব নাকি জরুরি। আসুন তো।
মিসির আলি বিস্মিত হলেন। বাড়িওয়ালার টেলিফোন নাস্বার তিনি কাউকে দেন নি। তিনি নিজেই জানেন না, কাজেই নাম্বার অন্যকে দেয়ার প্রশ্ন আসে না। জরুরি টেলিফোন মানে অসুখবিসুখ। মিসির আলির পরিচিত এমন কেউ নেই যার অসুখে জরুরি ভিত্তিতে তার খোঁজ পড়বে।
আজমল সাহেব বললেন, দেরি করছেন কেন, চলুন।
মিসির আলি বললেন, টেলিফোন ধরতে ইচ্ছা করছে না। তাদের বলুন আমি শুয়ে পড়েছি। মিথ্যা বলা হবে না। কারণ, আমি শুয়ে ছিলাম।
খুবই জরুরি কল। জরুরি না হলে ঝড়বৃষ্টির রাতে কেউ কল করে?
মিসির আলি অনিচ্ছার সঙ্গে পাঞ্জাবি পায়ে দিলেন। তখনই ইলেকট্রসিটি চলে গেল। পাঞ্জাবি উল্টা হয়েছে। পকেট ভেতরের দিকে চলে গেছে। পাঞ্জাবি ঠিক করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। আজমল সাহেব সাবধানী মানুষ ইলেকট্রসিটি থাকা সত্ত্বেও তিন ব্যাটারির একটা টর্চ সাথে নিয়ে এসেছেন। টৰ্চটা এখন কাজে আসছে।
আঞ্জামাল সাহেব বললেন, দরজায় তালা না দিয়েই রওনা হচ্ছেন। তালা দিন।
এখন তালা খুঁজে পাব না।
টাৰ্চটা নিয়ে খুঁজে বের করুন। ঘর খোলা রেখে যাবেন নাকি?
অসুবিধা নেই।
অবশ্যই অসুবিধা আছে। আমি প্রায়ই লক্ষ করেছি। দরজায় তালা না দিয়ে আপনি বাইরে যান। এটা ঠিক না। পাঞ্জাবিও দেখি উল্টা পরেছেন। পাঞ্জাবি ঠিক করে পরুন। মেয়েরা উন্টা শাড়ি পরলে নতুন শাড়ি পায়। ছেলেরা উল্টা কাপড় পরলে অসুখে পড়ে। এটা পরীক্ষিত সত্য।
আজমল সাহেবের বসার ঘরে টেলিফোন। সেখানেই বাড়ির মেয়েরা ভিসিআরো ছুবি দেখছে। ইলেকট্রসিটি নেই। এদের জেনারেটরও নেই। তারপরেও টিভিভিসিআর চলছে কী করে! দর্শকরা মিসির আলির দিকে তাকাল। তিনি সংকুচিত বোধ করলেন। অকারণে এতগুলো মানুষের বিরক্তি তৈরি করা। টেলিফোন না ধরলেই হতো! টেলিফোন নিয়ে যে দূরে চলে যাবেন সে উপায় নেই। কথাবার্তা ভিসিআরের দর্শকদের সামনেই বলতে হবে।
হ্যালো।
মিসির আলি সাহেব কথা বলছেন?
জি।
আমাকে চিনতে পারছেন?
জি না।
গলার স্বরটি কি চেনা মনে হচ্ছে না?
আমি টেলিফোনে গলার স্বর চিনতে পারি না।
আপনাদের দিকে কি বৃষ্টি হচ্ছে?
হুঁ হচ্ছে।