আজ যাদের দেখতে আসার কথা ছিল তারা দেখতে আসে নি?
উঁহু! খবর পাঠিয়েছে। একটা জরুরি কাজে আটকা পড়েছে বলে আসতে পারছে না, পরে এক সময় আসবে। আমার ধারণা এরা আর কোনোদিনই আসবে না।
এরকম ধারণা কেন?
বিয়ের কথাবার্তা হলে সবাই মেয়ে সম্পর্কে গোপনে খোঁজখবর করে। এরাও আমার সম্পর্কে খোঁজ করে ভয়ঙ্কর খবরটা জেনে ফেলেছে। আমার জীবনে একটা ভয়ঙ্কর খবর আছে।
ভয়ঙ্কর খবরটা কী?
রেবু খুব সহজভাবে বলল, আমার যখন ষোল বছর বয়স তখন আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। এক বছরের মতো পাগল ছিলাম। জেনেশুনে কেউ কি আর পাগল বউ ঘরে আনবে?
এখন তো তুমি আর পাগল না?
এখনো পাগল, তবে খুব সামান্য। আচ্ছা আমি উঠি, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তো, সন্ধ্যাবেলা আপনার ঘরে বসে থাকলে মামা খুব রাগ করবে। খারাপ কিছু ভাববে। খুব খারাপ কিছু। খুব খারাপ বলতে আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি বুঝতে পারছেন তো? অবশ্যই বুঝতে পারছেন। আপনার যা বুদ্ধি!
আবার এস।
আপনাকে বলতে হবে না। আমি আসব। আপনি তো আর জানেন না। আপনি আমাকে যা করতে বলবেন আমি তাই করব। আপনি যদি আমাকে রান্ত তিনটার সময় আসতে বলেন আমি আসব। যদিও স্থানি আপনি সেটা কখনো করবেন না।
মিসির আলি হতাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। রেবু ঠিকই বলেছে তার পাগলামি পুরোপুরি সারে নি। এখনো বেশ খানিকটা আছে।
রেবু বলল, আচ্ছা কিছুক্ষণ আগে একটা লোক এসেছিল। আপনার কাছে। সে কে?
তার নাম মনসুর।
লোকটা অনেকক্ষণ আপনার কাছে ছিল।
হুঁ।
কে আপনার কাছে আসে, কখন আসে, কতক্ষণ থাকে।—সব আমি খেয়াল রাখি।
ও আচ্ছা!
লোকটা কিন্তু ভালো না। আপনি ওকে আপনার কাছে আসতে নিষেধ করে দেবেন।
লোকটা ভালো না বুঝলে কী করে?
সে যখন চলে যাচ্ছিল তখন আমি দোতলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। লোকটা আমার দিকে তাকাল। খুব খারাপভাবে তাকিয়েছিল। আপনি অবশ্যই তাকে এখানে আসতে নিষেধ করে দেবেন।
আচ্ছা।
যদি দেখি সে আবারো আপনার কাছে এসেছে তাহলে আমি কিন্তু খুব রাগ করব। আজ যাই?
আচ্ছা।
আপনার জন্য কি চা বানিয়ে ফ্লাঙ্কে করে পাঠিয়ে দেব?
না, দরকার নেই।
অবশ্যই দরকার আছে। সন্ধ্যাবেলা মানুষের চা খেতে ইচ্ছা করে না! আমি চা পাঠিয়ে দেব। ঘরে যদি কোনো খাবার থাকে তাও পাঠাব। মনে হয় নেই। মামাদের বাসায় বিকেলে নাশতা খাবার চল নেই। সন্ধ্যা মিলাতে না মিলান্ত্ৰে সবাই চা খেয়ে ফেলে। যাই হোক, আমি আপনার জন্য চা পাঠাচ্ছি।
আচ্ছা ঠিক আছে।
সুগার পটে আলাদা করে চিনি দিয়ে দেব। কষ্ট করে নিজে মিশিয়ে নেবেন। পারবেন না?
পারব।
রেবু চলে গেল। মিসির আলি মনে মনে হাসলেন। চা পাঠানের কথা, নাশতা পাঠানোর কথা এই মেয়ে আগে অনেকবার বলেছে। চা-নাশতা কখনো আসে নি। আজো আসবে না।
মেয়েটি সম্পর্কে মিসির আলি তেমন কিছু জানেন না। সে চাঁদপুরে থাকে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে মামার কাছে বেড়াতে এসেছে। মামা মেয়েটির বিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। রেবু সম্পর্কে এইটুকু তথ্য তাঁর কাছে আছে। আজ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি তথ্য। ষোল বছর বয়সে মেয়েটি পাগল হয়ে গিয়েছিল। খুবই ভয়াবহ তথ্য। ভয়াবহ কারণ পাগলামিকে এক ধরনের অসুখ বলা হলেও এই অসুখের জাত আলাদা। এই অসুখ মানুষের কনসেন্সকে আক্রমণ করে। কনসেন্স হচ্ছে মানুষের অস্তিত্ব। যে অসুখ অস্তিত্বের শিকড় ধরে টান দেয়। সেই অসুখ অসুখ না, অন্য কিছু।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মিসির আলি চেয়ারে বসে আছেন। তার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা। যেন কোনো একটা জটিল হিসেব মিলছে না।
জটিল হিসেবের ব্যাপারটা আসছে। কেন তাও বুঝতে পারছেন না। আজ সারা দিন তিনজন মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে-রেবুর মামা, মনসুর এবং বেবু। এরা এমন কিছু কি করেছে যা তিনি সারা দিন ধরতে পারেন নি।–তার অবচেতন মন ধরে ফেলেছে। এবং অবচেতন মন চেতন মনের কাছে একটু পরপর খবর পাঠাচ্ছে। অবচেতন মন খবর পাঠায় নানা ধরনের প্রতীকের মাধ্যমে, ধাঁধার মাধ্যমে। সেই সব প্রতীক এবং রিডলস ডিকোড করার দায়িত্ব চেতন মনের। চেতন মন তা করতে পারছে না।
আচ্ছা, এক এক করে। ধরা যাক। প্রথমে রেবুর মামা-আজমল সাহেব।
আজমল হোসেন
বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ। রোগী! সামান্য ইস্পানির মতো আছে। জর্দা দিয়ে প্রচুর পান খান! ব্যবসায়ী মানুষ বাড়ি ভাড়া দেন। কর্ম টাইপ! সারা দিন কাজ করেন। রাত দশটার মধ্যে শুয়ে পড়েন। ব্যবসায়ীদের কখনো সুনিদ্রা হয় না। তার হয়। মোটামুটি রুটিনে বাধা জীবন। সপ্তাহে তিন দিন বাজার করেন। বুধ, শুক্র, রবি। রবিবারে আমিন বাজার থেকে গরুর মাংস কেনেন। বৃহস্পতিবার রাতটা ধর্ম-কর্মের জন্য আলাদা করা। সেদিন সন্ধ্যায় কাকরাইল মসজিদে যান মাগরেবের নামাজ পড়তে। নামাজ শেষ করে বাসায় ফিরে এসে স্ট্রর স্বাড়ির ছাদের ঘরে জিকির করেন। মিসির আলি এক বছর হল এ বাড়িতে সাবলেট থাকেন। এক বছর রুটিনের ব্যতিক্রম হতে দেখেন নি।
মনসুর নামে যুবকটির কথা ভাবা যাক। মনসুর কি তার আসল নাম? কেন জানি মনে হয় মনসুর তার আসল নাম না। কেন জানি মনে হচ্ছে আবার কী? অকারণে মানুষের কিছু মনে হয় না। প্রতিটি মনে হবার পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকতে হবে। মনসুর যুবকটির আসল নাম না এটা মনে হবার কারণ কী? মনসুর শব্দটা সে অদ্ভুত ভালো উচ্চারণ করছে এইটা কি কারণ? সেই দুই সিলেবলেই বলে মন সুর। মনসুর যদি যুবকটির নাম হতো তা হলে সে এক সিলেবলেই উচ্চারণ করত। শব্দটির সঙ্গে সে খুব পরিচিত নয় বলেই…