একটা সময় ছিল যখন কলম, ঘড়ি, চশমা এই তিনটি জিনিসকে সাজগোছের অংশ ধরা হতো। ইন্ত্রি করা শার্টের পকেটে থাকবে কািলম। চোখে জিরো পাওয়ারের চশমা, হাতে ঘড়ি। রেডিওতে যখন খবর পাঠ করা হবে তখন চট করে হাতঘড়ির সময় মিলিয়ে নেয়াও কালচারের অঙ্গ ছিল। একে বলা হতো রেডিও টাইম। আজকাল কেউ বোধ হয় খবর শুনে ঘড়ির টাইম ঠিক করে না। রেডিও টাইম বলেও বোধ হয় কিছু নেই। রেডিওর পরে অনেক কিছু চলে এসেছে-টিভি টাইম, স্যাটেলাইট টাইম। আচ্ছা মনসুরের হাতে কি ঘড়ি ছিল? মিসির আলি মনে করতে পারলেন না। সম্ভবত ছিল না। থাকলে চোখে পড়ত। কিংবা হয়তো ছিল, তার চোখে পড়ে নি। চোখে পড়ার ক্ষমতা কমে গেছে। বাৰ্ধক্য গুণনাশিনী।
এই যুবকের মধ্যে বিশেষ কিছু কি আছে যা দিয়ে তাকে আলাদা করা যায়? identification Mark, পাসপোর্টে যেমন লেখা থাকে, অবশ্যই আছে। থাকতে হবে! পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই আলাদা। প্রতিটি মানুষের আঙুলের ছাপ আলাদা। একজন মানুষের আঙুলের ছাপ পৃথিবীর জীবিত বা মৃত কোনো মানুষের সঙ্গে মিলবে না! গায়ের গন্ধ দিয়েও মানুষকে আলাদা করা যায়। প্রতিটি মানুষের গায়ের গন্ধ আলাদা। কুকুর মানুষকে তার চেহারা বা কাপড়-চোপড় দিয়ে চেনে না, চেনে গায়ের গন্ধ দিয়ে।
মিসির আলির চোেখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। আধ্যাত্মিক ক্ষমতাধর যুবক কি যাবার আগে তাঁকে হিপনোটাইজি করে গেছে? সন্ধ্যাকেলায় তার কখনো ঘুম আসে না। আজ কেন আসছে? মিসির আলি কয়েকবারই চেষ্টা করলেন ঘুমের ঘোর থেকে উঠে আসতে। পারলেন না। তার চোখের পাতায় কেউ যেন অম্বাইক গাম লাগিয়ে দিয়েছে।
ঘুমাচ্ছেন?
মিসির আলি চোখ মেললেন। বাড়িওয়ালার ভাগ্নি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা আজ শাড়ি পরেছে। শাড়িতে তাকে শুধু যে বড় লাগছে। তাই না, সুন্দরও লাগছে। কিছুটা সাজগোছও করেছে। গোসল করে চুল বেঁধেছে। চোখে কাজল দিয়েছে। গলায় সোনার চেইন চিকচিক করছে। দুই হাতে সোনার চুড়ি। পায়ের লাল স্যান্ডেল জোড়াও মনে হয় নতুন। চোখে কাজল দেয়ার জন্য হয়তো-চোখের দিকে তাকালে মায়া-মায়া ভাব হচ্ছে। চোখে কাজল পরলে মায়া ভাব আসে কেন? কালো রঙের সঙ্গে কি মায়া সম্পর্কিত?
তোমার কী খবর রেবু?
জি ভালো। আপনি অসময়ে চেয়ারে বসে ঘুমুচ্ছিলেন কেন? শরীর খারাপ?
ঘুমাচ্ছিলাম না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম।
আমি কি বসবা আপনার সামনের চেয়ারটায়?
বস।
আমি যে প্রায়ই এসে আপনাকে বিরক্ত করি আপনি বিরক্ত হন না তো?
না, আমি বিরক্ত হই না। তা ছাড়া তুমি প্রায়ই আস না তো। হঠাৎ হঠাৎ আস।
মেয়েটা মাথা দুলিয়ে বলল, আমি রোজই আসি। সব দিন আপনার সঙ্গে কথা বুলি না। ধারাহ্মা থেকে অ্যাবাউট টার্ন করে চলে যাই। আপনার কাছে আসি না। মামার কারণে আসি না। বারবার আপনার এখানে আসতে দেখলে মামা হয়তো অন্য কিছু ভেবে বসবে।
মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, কী ভাববে?
রেবু শান্ত গলায় বলল, ভাববে আপনার সঙ্গে আমার প্রেম হয়ে গেছে।
রেবু চেয়ারে বসল। মিসির আলি মেয়েটির কথায় হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলালেন। চেয়ারে বসার ভঙ্গি খুব ভালো করে লক্ষ করলেন। সব মানুষ একভাবে চেয়ারে বসে না। একেকজন একেকভাবে বসে। কেউ ধাপ করে বসে পড়ে। কেউ বসে নরম ভঙ্গিতে। যেন চেয়ারে বসছে না, কারো কোলে বসছে।
রেবু বলল, আজ আমাকে খুব সুন্দর লাগছে না?
হুঁ, লাগছে।
আপনার ঘরে আলো কম তো, এই জন্য ঠিকমতো দেখতে পারছেন না। আজ আমাকে ফরাসাও লাগছে।
ও, আচ্ছা!
আজ আমি এত সাজগোছ করেছি। কেন, বলুন তো?
বুলতে পারছি না।
কী আশ্চৰ্য, বলতে পারছেন না কেন? আমার মামার ধারণা আপনার অসম্ভব বুদ্ধি এবং আপনি সবকিছু বলতে পাবেন! মামা কী বলে জানেন? মামা বলে, আপনি যে কোনো মানুষকে পাঁচ মিনিট চোখের দেখা দেখে বলে দিতে পারেন দুদিন আগে দুপুরবেলা সে কোন তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েছিল।
মিসির আলি হেসে ফেললেন। প্লেবুর মামা আজমল সাহেবের তার প্রসঙ্গে উচ্চ ধারণার কথা মিসির আলি জানেন। সেই ধারণা এতটা উঁচুতে তা জানতেন না। মানুষ বাড়িয়ে কথা বলতে ভালবাসে। এই ভদ্রলোক অনেক বেশি ভালবাসেন।
রেবু পা দোলাতে দোলাতে বলল, বলুন তো, আজ দুপুরবেলা আমি কী দিয়ে ভাত খেয়েছি?
মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, ইলিশ মাছ দিয়ে কচুর লতিও রান্না হয়েছিল। তুমি কচুর লতি খাও নি?
রেবু হতভম্ব গলায় বলল, আশ্চর্য কী করে বললেন?
কী করে বললাম সেটা তো আমি বলব না।
প্লিজ বলুন! আমি আপনার পায়ে পড়ি। কথার কথা না। আমি কিন্তু সত্যি আপনার পায়ে ধরব। প্রশ্নের উত্তর না দেয়া পর্যন্ত ছাড়ব না। আমি পাগল টাইপ মেয়ে। যা বলি তা করে ফেলি।
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আজ সকালে তোমার মামা যখন বাজার করে ফিরছিলেন তখন আমি বারান্দায় বসা! তোমার মামা বললেন, বাজারে কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। মাছের মধ্যে শুধু ইলিশ। আমি দেখলাম বাজারের ব্যাগে দুটা ইলিশ মাছ! আর কচুর লতি। তুমি একবার বলেছিলে তুমি কচুর লতি খাও না। তোমার গলা কুটকুট করে। কাজেই সব মিলিয়ে-ঝিলিয়ে বলেছি। আমার কোনো আধ্যাত্মিক ক্ষমতা নেই।
আমি প্ৰায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম।—আপনার অনেক ক্ষমতা।
মিসির আলি হাসলেন। রেবু বলল, আজ আমি সাজগোছ করেছি। কারণ হলআজ বিকেলে আমাকে দেখতে আসার কথা ছিল। আমাকে বিয়ে দেবার খুব চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রায়ই লোকজন আমাকে দেখতে আসছে।