মনসুর শান্ত গলায় বলল, দেখাতে হবে না। আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি।
আঁখিতারা চা নিয়ে ঢুকেছে। মনসুর সহজভাবেই চায়ের কাপে চুমুক দিল। মিসির আলি বললেন, মনসুর শোনো। লজিক হচ্ছে সিঁড়ির মতো। লজিকের একটি সিঁড়িতে পা দিলে অন্য সিঁড়ি দেখা যায়। তুমি আমার ঘরে ঢুকেছ এটা জানার পর বুঝতে পারলাম রেবু মেয়েটির সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে।
কীভাবে বুঝলেন?
আমার বাসার একটা দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। সেই তালা খুলে এ বাসায় ঢোকা যায়। তালার চাবি রেবুর কাছে আছে। সেই চাবির একটা নিশ্চয়ই তোমার কাছেও আছে। আছে না?
হ্যাঁ আছে।
রেবুদের বাড়ির টেলিফোন নাম্বারও তুমি জানো। তুমি আমাকে ওই বাড়িতে টেলিফোন করেছিলে। মনে আছে?
আছে।
আমি একটা নতুন পাঞ্জাবি পরে সেজোগুজে বসে আছি। আমার কাজের মেয়েটা আমাকে তাড়া দিচ্ছে বের হওয়ার জন্য। তুমি একবারও জিজ্ঞেস করলে না আমরা কোথায় যাচ্ছি। জিজ্ঞেস করোনি কারণ তুমি জানো আমরা কোথায় যাচ্ছি। রেবুর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে তা জানা সম্ভব না। তুমি কি জানো আজ রেবুর বিয়ে?
মনসুর বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল।
মিসির আলি বললেন, তুমি এই বাসায় এক সময় ভাড়াটে ছিলো। আমার এই অনুমান কি ঠিক আছে?
মনসুর চমকে উঠে বলল, এই তথ্য আপনাকে কে দিয়েছে?
মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, রান্নাঘর দিয়েছে। রান্নাঘরের দেয়ালে হাজি আজমত আলি নামের এক ভদ্রলোকের নাম এবং টেলিফোন নাম্বার লেখা। তোমার হাতের লেখা আমি চিনি।
আপনি কি আমার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য হাজি আজমত আলিকে টেলিফোন করেছিলেন?
না, টেলিফোন করি নি। তুমি এই বাড়িতে কতদিন ছিলে?
তিন মাস।
আমার ধারণা রেবুর সঙ্গে তখনই তোমার পরিচয় এবং প্রণয়। রেবু কি নিশিরাতে তালা খুলে তোমার ঘরে আসত?
হ্যাঁ।
অবস্থাটা তো তোমার জন্য ভালোই ছিল। তুমি তিন মাসের মধ্যে চলে গেলে কেন? রেবুর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল বলে?
হুঁ।
মিসির আলি বললেন, আমার সিগারেট শেষ হয়ে গেছে, একটা সিগারেট দাও। মনসুর সিগারেট দিল। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিল। মিসির আলি বললেন, মনসুর তুমি কি মানুষ খুন করেছ?
মনসুর বলল, জি না।
রেবুকে পরামর্শ দিয়েছিলে তার স্বামী-সন্তান খুন করতে?
জি না।
তুমি যদি কিছু বলতে চাও বলো। আমি তোমার কথা খুব মন দিয়ে শুনব।
স্যার, রেবুর বাচ্চা হওয়ার পর তার সংসারে খুব অশান্তি শুরু হলো। রেবুর স্বামীর ধারণা হলো বাচ্চাটা তার না। রেবু একদিন স্বীকারও করল বাচ্চার বাবা অন্য একজন। তারপর দু’জনকেই বঁটি দিয়ে কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলল।
তুমি আমার ঘরে কেন আসতে?
স্যার, আমি আপনাকে ভয় দেখিয়ে এই বাসা থেকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম। কারণ, রেবু প্রায়ই বলত সে আপনাকে খুন করতে চায়। সে অসুস্থ একটা মেয়ে। ভয়ঙ্কর অসুস্থ। আপনাকে এই কথাটাই বারবার বলার চেষ্টা করেছি। আপনার বেঁচে থাকা আমার জন্য দরকার।
কেন?
স্যার, একমাত্র আপনিই রেবুকে সুস্থ করে তুলতে পারবেন। আর কেউ পারবে না। স্যার, আমি এই অসুস্থ মেয়েটাকে ভয়ঙ্কর ভালোবাসি।
মনসুর তাকিয়ে আছে। এই চোখের ভাষা মিসির আলি পড়তে পারছেন না। এই চোখ মমতা এবং ভালোবাসায় আর্দ্র।
মনসুরের চোখে পানি জমতে শুরু করছে। মিসির আলি অপেক্ষা করছেন চোখ থেকে পানির ফোঁটাটা কখন টেবিলের ওপর পড়ে। মনসুর যেভাবে বসে। আছে পানির ফোটা টেবিলে পড়ার কথা। অশ্রু চোখেই মানায়। কাঠের টেবিলে মানায় কি-না এটা তার দেখার ইচ্ছা।