রেবু বলল, না।
মিসির আলি বললেন, তোমার কাছে আমার একটা প্রশ্ন ছিল।
রেবু সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসল। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। অতিরিক্ত টেনশনে তার নাক ফুলে ফুলে উঠছে। মিসির আলি বললেন, তুমি ঘাবড়ে গেছ কেন? জটিল কোনো প্রশ্ন না। হিন্দি ছবি দেখেছিলাম তোমাকে সঙ্গে নিয়ে। সেই ছবি নিয়ে প্রশ্ন।
কী প্রশ্ন?
নায়ক যখন মারামারি করছিল তখন দেখলাম তার শার্টের একটা বোতাম নেই। কিন্তু মৃত্যুদৃশ্যের সময় দেখলাম শার্টের সবগুলো বোতামই আছে। এটা কী করে সম্ভব?
রেবু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, মৃত্যুদৃশ্যটা তারা আগে করেছে। তখন শার্টের বোতাম ছিল। মারামারি দৃশ্যের সময় বোতাম খুলে গেছে।
মিসির আলি বললেন, এত জটিল সমস্যার এত সহজ সমাধান? আমি বুঝতেই পারি নি।
রেবু বলল, আপনি ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। আমার কাছে বুঝতে না পারার ভাব করেছেন।
তোমার সঙ্গে এটা কেন করব?
আমাকে বোঝানোর জন্য যে, আপনার বুদ্ধি কম। আপনার যে খুব বুদ্ধি এটা আমি জানি। এত বুদ্ধি থাকা ভালো না।
মিসির আলি আচমকা অন্য একটা প্রশ্ন করলেন। তিনি রেবুর দিকে ঝুকে এসে বললেন, তোমাদের বাড়ির বারান্দার দিক থেকে আমার এই বাসায় ঢোকার একটা দরজা আছে। দরজাটা তোমাদের দিক থেকে তালাবন্ধ থাকে। সেই তালার চাবি কি তোমার আছে?
রেবু কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, আছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন?
মিসির আলি বললেন, না।
রেবু তাকিয়ে আছে। তার চোখ বড় বড়। মিসির আলির ধারণা ছিল তিনি মানুষের চোখের ভাষা পড়তে পারেন। তিনি হঠাৎ লক্ষ করলেন, রেবুর চোখের ভাষা তিনি পড়তে পারছেন না। এর চোখের ভাষা অচেনা হয়ে গেছে।
রাত নটা বাজে। আজমল সাহেব দুইবার মিসির আলিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক পাঠিয়েছেন। মিসির আলি যেতে পারছেন না। কারণ মনসুর তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সে সঙ্গে করে অনেকগুলো তাজা দোলনচাঁপা নিয়ে এসেছে। মিসির আলি দোলনচাঁপার নাম পড়েছেন নজরুলের কবিতা বইয়ে। দোলনচাঁপা আগে কখনো দেখেন নি। ফুল দেখে এবং ফুলের গন্ধে তিনি মুগ্ধ হলেন। পুরো বাড়িতেই মিষ্টি সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে। মিসির আলি বললেন, বাহ!
মনসুর বলল, স্যার ফুলগুলো আপনার পছন্দ হয়েছে?
মিসির আলি বললেন, খুব পছন্দ হয়েছে। থ্যাঙ্ক য়্যু।
মনসুর পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বলল, স্যার, মাঝে মাঝে আমি আপনার সামনে বেয়াদবি করি। সিগারেট খাই। আপনি কিছু মনে করবেন। না। টেনশনের সময় আমি সিগারেট না খেয়ে থাকতে পারি না।
মিসির আলি বললেন, সামনে সিগারেট খাওয়া-না-খাওয়া নিয়ে আদবের সম্পর্কটা আমি ঠিক বুঝতে পারি না। তুমি যত ইচ্ছা সিগারেট খাও। কোনো সমস্যা নেই।
মনসুর কয়েকবার চেষ্টার পর তার লাইটারটা ধরাল। মিসির আলি হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেললেন।
মনসুর অবাক হয়ে বলল, আপনি হাসছেন কেন?
মিসির আলি বললেন, লাইটারের শব্দ শুনে হাসলাম। লাইটারটা তুমি বাঁ হাতে ধরিয়েছ, এটা দেখেও হাসলাম।
মনসুর বলল, আমি লেফটহ্যান্ডার। স্যার, এটা কি কোনো হাসির ব্যাপার। আমি যতদূর জানি, এই পৃথিবীর দুই পারসেন্ট মানুষ লেফটহ্যান্ডার।
মিসির আলি বললেন, আমি কেন হেসেছি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি। একবার আমার বাসায় গভীর রাতে কেউ একজন ঢুকেছিল। সেটা খুব বৃষ্টির রাত ছিল। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। যে ঢুকেছিল সে চাচ্ছিল আমি যেন টের পাই কেউ একজন এসেছে, কিন্তু কে এসেছে সেটা যেন বুঝতে না পারি।
আপনি বুঝে ফেলেন কে এসেছে?
হ্যাঁ। তুমি এসেছিলে।
মনসুর শান্ত গলায় বলল, আমি লেফটহ্যান্ডার এটা জেনেই আপনি টের পেলেন আমি আপনার ঘরে ঢুকেছি? লেফটহ্যান্ডাররা গভীর রাতে মানুষের বাড়িতে ঢোকে?
মিসির আলি বললেন, তুমি পুরোটা না শুনেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছি। আগে পুরোটা শোনো। নাৰ্ভ ঠাণ্ডা করো। আরেকটা সিগারেট ধরাও।
মনসুর আরেকটা সিগারেট ধরাল। আর তখনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে আঁখিতারা ঘরে ঢুকে বলল, বড় বাবা, আপনি যাবেন না?
মিসির আলি বললেন, তুমি বিয়ে বাড়িতে চলে যাও, আমি আসছি।
আঁখিতারা বলল, আমি আপনেরে না নিয়া যাব না।
তাহলে অপেক্ষা করো। সুন্দর করে দু’কাপ চা বানিয়ে দিয়ে যাও।
খিতারা চলে গেল। মিসির আলি মনসুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওই রাতে তুমি কিছুক্ষণ আমার ঘরে হাঁটাহাঁটি করলে। আমার ঘুমভাঙা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে। তারপর ঘর থেকে বের হলে। যতক্ষণ ঘরে ছিলে ততক্ষণ টেনশনে তোমার স্নায়ু আড়ষ্ট ছিল। স্মোকাররা টেনশন কমাতে সিগারেট টানে। ঘর থেকে বের হয়েই তুমি সিগারেট ধরালে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল বলেই পুরো সিগারেটটা তুমি আমার বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে শেষ করলে। সিগারেটের গন্ধে আমি তোমাকে চিনলাম না। তোমাকে চিনলাম লাইটারের শব্দে। তোমার লাইটারের শব্দ আমি চিনি।
মনসুর চুপ করে আছে। সে এখন আর সিগারেটে টান দিচ্ছে না। তবে তাকিয়ে আছে সিগারেটের ধোঁয়ার দিকে।
মিসির আলি বললেন, তুমি লেফটহ্যান্ডার এটাও কিন্তু একটা ইন্টারেস্টিং কো-ইনসিডেন্স। শুনলে তুমি মজা পাবে। বলব?
বলুন।
তুমি আঁখিতারার বিছানায় বসেছ। তার ঘাড়ের ডান দিকে চিমটি দিয়েছ। আঁখিতারা উত্তর দিকে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিল। এই অবস্থায় তার ঘাড়ের ডান দিকে একজন লেফটহ্যান্ডার চিমটি দেবে। রাইটহ্যান্ডার চিমটি দেবে ঘাড়ের বা দিকে। ব্যাপারটা বুঝতে না পারলে আমি একটা কাজ করি, আঁখিতারাকে বিছানায় শুইয়ে তার পাশে বসে দেখাই কেন একজন ঘাড়ের বাঁ দিকে চিমটি দেবে, আরেকজন দেবে ডান দিকে। দেখাব?