মিসির আলি বললেন, শরীর খারাপ না। শরীর ভালো।
আপনে ঘুমাইতেই আছেন। ঘুমাইতেই আছেন। ঘুমাইতে ঘুমাইতে মানুষ মারা যায়।
কে বলেছে?
বড় বাবা বলেছে। এই জন্যে বড় বাবা যখন বেশি ঘুমায় তখন আমার ভয় লাগে। আমি ডাক দিয়া তুলি।
আমাকে ডাক দিয়ে তুললে না কেন?
আমি ডাকছি। আপনের ঘুম ভাঙে নাই।
মিসির আলি বললেন এত লম্বা আরামের ঘুম কেন ঘুমিয়েছি শোনো। কারণটা কিছুক্ষণ আগে পরিষ্কার হয়েছে। আমার মাথা জট পাকিয়ে গিয়েছিল। আন্ধা গিন্টু লেগে গিয়েছিল। গিন্টু খুলে গেছে বলে আরাম করে ঘুমিয়েছি, বুঝেছি?
কিছু না বুঝেই আঁখিতারা মাথা নাড়ল। মানুষটা যে ঘুমের মধ্যে মরে যায় নি। এতেই সে খুশি।
রাতে মিসির আলি আজমল সাহেবের বাড়িতে খেতে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়লেন। বাড়িতে শোকের ছায়া। বরপক্ষের লোকজন কেউ আসে নি। তারা কোনো খবরও পাঠায় নি। আজমল সাহেব বললেন, মানুষ এত খারাপ কেন, বলেন তো ভাই সাহেব? আসবি না ভালো কথা। একটা খবর তো দিবি।
মিসির আলি বললেন, ক’টার সময়ে আসার কথা?
সন্ধ্যাবেলা আসার কথা। মুরুব্বিরা আসবে, বিয়ের কথাবার্তা হবে, তারপর খানাপিনী।
রাস্তার যানজটে মনে হয় আটকা পড়েছে। সব মুরুব্বিদের একত্র করে আসতেও দেরি হয়।
আজমল সাহেব হতাশ গলায় বললেন, ওরা আসল খবর পেয়ে গেছে। সবকিছু এত গোপন করে রাখি, তারপরেও আসল খবর বের হয়ে যায়। আপনি আমার নিজের লোক, আপনাকে বলি। রেবুর আগে বিয়ে হয়েছিল। একটা মেয়েও হয়েছিল। স্বামী-সন্তান দু’জনই মারা যায়। তারপর থেকে রেবুর মাথা খারাপ। নতুন করে ঘর-সংসার হলে মাথা ঠিক হয়ে যেত। মাথা খারাপের আসল অষুধ বিবাহ।
প্রশ্ন করবেন না করবেন না ভেবেও মিসির আলি প্রশ্ন করে ফেললেন। তিনি ইতস্তত করে বললেন, তারা মারা যায় কীভাবে?
আজমল সাহেব বললেন, কাজের মেয়ে খুন করে টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি নিয়ে পালিয়ে যায়। বিশাল ইতিহাস। আরেকদিন বলব। আপনাকে বলতে কোনো বাধা নেই রে ভাই। আপনি আমার আপনা লোক। পুলিশ টাকা খাওয়ার জন্যে কী যে করেছে বললে বিশ্বাস হবে না। পুলিশ আসামি করেছিল রাবেয়াকে।
রাবেয়া কে?
রেবুর ভালো নাম রাবেয়া। ঘটনার পরে আমরা রেবুর নাম চেঞ্জ করে ফেলি–তার নাম দেই শেফালী। ডাক নাম শেফু। মেয়েটার বিয়ে তো দিতে হবে। আগের নামধাম রাখার কোনো যুক্তি আছে, আপনিই বলেন?
মিসির আলি কিছু বললেন না। ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেললেন। আজমল সাহেব মিসির আলির দিকে এগিয়ে এসে গলা নিচু করে বললেন, স্ত্রী স্বামীকে খুন করে, এ ইতিহাস আছে। কিন্তু কোনো মা তার সাত মাসের ফুটফুটে বাচ্চা খুন করতে পারে? আপনি বলেন? আপনি তো ‘বোকা.. না’ খারাপ কথা বলে ফেলেছি। ভাই, কিছু মনে করবেন না।
আজমল সাহেব বললেন, তোরা পারলে যে কাজের মেয়ে খুন করে পালিয়েছে তাকে ধরে আন। তা না, উল্টাপাল্টা জেরা। রেবুর মাথাটাই খারাপ করে দিল। মামলা থেকে রেবুকে বের করে আনতে কত টাকা গেছে বলুন তো? দেখি আপনার অনুমান?
বলতে পারছি না। মামলা-মুকাদমা বিষয়ে আমার অনুমান খুবই খারাপ।
চার লাখ একুশ হাজার। থানা স্টাফ নিয়েছে দুই লাখ, আর এসপি সাহেবকে দিয়েছি দুই লাখ।
মিসির আলি বললেন, একুশ হাজার টাকার হিসাবটা কী?
পত্রিকাওয়ালাদের দিতে হয়েছে। উল্টাপাল্টা খবর ছেপে দিলে মুশকিল না? ভাই সাহেব আপনার কি ক্ষিদে লেগেছে? খানা দিতে বলি?
মিসির আলি বললেন, আরেকটু অপেক্ষা করি।
আজমল সাহেব বললেন, কোনো লাভ নেই। শুয়োরের বাচ্চারা আসবে না। রেবু মেয়েটা কী কপাল নিয়ে এসেছে! ঝাড়ু মারি কপালে। একবার ইচ্ছা করে আমিই গলা টিপে মেয়েটিকে শেষ করে দেই। যন্ত্রণা শেষ হোক।
নিচে গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। একটা না, বেশ কয়েকটা গাড়ি। মিসির আলি বললেন, আমার ধারণা বর পক্ষের লোকজন চলে এসেছে। আপনার পীর ভাই-এর কথা সত্যিই হয়েছে।
আজ রেবুর বিয়ে
আজ রেবুর বিয়ে। আয়োজনের হৈচৈ ধরনের বিয়ে না। নিয়মরক্ষা বিয়ে। মগবাজারের কাজী অফিস থেকে কাজী সাহেব আসবেন। বর পক্ষে কিছু লোকজন থাকবে। পাঁচ লক্ষ এক টাকা কাবিন। অর্ধেক গয়নাপাতিতে উসুল। আজমল সাহেব প্রায় জীবন দিয়ে দিচ্ছেন মিসির আলি যাতে কনের দিকের একজন উকিল হন। মিসির আলি কাটান দিয়ে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত কাটান দিতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।
বিয়ের কনে রেবুর সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। সে সকালবেলা নতুন পাঞ্জাবি নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আজমল সাহেব পাঞ্জাবি পাঠিয়েছেন। তিনি চান মিসির আলি বিয়ের আসরে এই পাঞ্জাবি পরে উপস্থিত হবেন। আঁখিতারাও এই উপলক্ষে লাল পাড় ড়ুরে লাল শাড়ি পেয়েছে। বিয়ে হবে সন্ধ্যায়, আঁখিতারা সকাল থেকেই শাড়ি পরে সেজেগুঁজে বেড়াচ্ছে। মিসির আলিকে বলেছে, তাকে কাচের চুড়ি কিনে দিতে হবে। কাচের চুড়ি না পেলে সে বিয়েতে যাবে না।
রেবু মিসির আলির পা ছুঁয়ে সালাম করল। মিসির আলি বললেন, আজ তোমার জন্য বিশেষ দিন।
পাঞ্জাবি টেবিলে রেখে রেবু কিছু বলল না।
মিসির আলি বললেন, উন্নত একটা দেশে যাচ্ছ। তাদের চিকিৎসাব্যবস্থা খুব ভালো। অবশ্যই সেখানে তুমি ভালো ডাক্তার দেখাবে। সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তোমার ভালো চিকিৎসা দরকার।
রেবু ঘাড় কাত করল।
মিসির আলি বললেন, তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?