মিসির আলি ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছটা দশ। সন্ধ্যা হয়-হয় করছে। সন্ধ্যাবেলাটা তাঁর একা থাকতেই ভালো লাগে! মানসিক ক্ষমতাওয়ালা কারো সামনে বসে থাকতে ইচ্ছা করে না। মনসুর এখনো বসে কেন তিনি বুঝতে পারছেন না। সে তার মেন্টাল ম্যাজিক দেখাতে চেয়েছিল দেখানো হয়েছে। আরো কিছু কি বাকি আছে? নাকি সে তার ঘুম পাড়ানো ক্ষমতাও দেখাবো! যাবার আগে তাকে ঘুম পাড়িয়ে চলে যাবে। সন্ধ্যাবেল তিনি চেয়ারে বাঁকা হয়ে বসে নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে পারবেন।
মনসুর আরেকটা সিগারেট ধরাল। মিসির আলি লক্ষ করলেন, দিয়াশলাই জ্বালানোর সময় তার হাত সামান্য কাঁপছে! পারকিনসন্স ডিজিজ প্রাথমিক অবস্থায় এরকম হয়। এই যুবকের পারকিনসন্স ডিজিজ আছে বলে মনে হচ্ছে না। তা হলে আঙুল কাঁপছে কেন? মানসিক অস্থিরতা? মনের প্রবল অস্থিরতা শরীরে ছায়া ফেলে। মনের প্রবল কাঁপুনি শরীরে চলে আসে।
মনসুর সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে মিসির আলির দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, এই জাতীয় ক্ষমতা সবচে বেশি দেখা যায় যোগী-সন্ন্যাসীদের মধ্যে। এদের অনেকেই লেভিটেশন করতে পারেন। লেভিটেশন হচ্ছে শূন্যে ভাসা। অসম্ভব কোনো ব্যাপার না। দীর্ঘ সাধনার প্রয়োজন। সাধনা এবং মনের কনসেনট্রেশন। সাধনা আমি করে যাচ্ছি-সমস্যা একটাই, মনের একাগ্রতাটা আসছে না। মন খুবই বিক্ষিপ্ত।
ও আচ্ছা।
লেভিটেশনের দিকে আমি অনেকটা এগিয়েছি! মাটি থেকে এক ইঞ্চির মতো উঠতে পারি।
ও আচ্ছা।
বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। পাঁচ-দশ সেকেণ্ড পারি।
যুবক বিস্মিত চোখে তাকাল। তার বিস্মিত হবার কারণ আছে। মিসির আলি তাকিয়ে আছেন আগ্রহশূন্য চোখে। তার ভাবভঙ্গিতে এটা স্পষ্ট যে-মানসিক ক্ষমতাধর যুবকটি বিদায় হলে তিনি খুশি হবেন। তিনি যুবকের শূন্যে ভাসা দেখতে চান না।
স্যার, আমি উঠি?
আচ্ছা।
আমার মেন্টাল ম্যাজিক মনে হয় আপনার ভালো লাগে নি?
মিসির আলি জবাব দিলেন না। মনসুর বলল, আমার ক্ষমতার ব্যাপারটা কেমন লেগেছে একটু কি বলবেন?
মিসির আলি বললেন, মোটামুটি লেগেছে।
যুবক চাপা গলায় বলল, মানুষের মনের ক্ষমতা অনুভবের ব্যাপার। মানসিক ক্ষমতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ কখনোই পাওয়া যায় না। সেই প্ৰমাণ আমি দেখালাম তারপরেও আপনি বলছেন মোটামুটি?
হ্যাঁ তা বলছি।
আমি কি জানতে পারি এখন আপনি মোটামুটি না বলে বলবেন—চমৎকার?
মিসির আলি ছোট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। অপ্রীতিকর একটা কথা এখন তাকে বলতে হবে। বলতে না পারলেই তিনি খুশি হতেন। কিন্তু উপায় নেই। এই যুবক অপ্রীতিকর কথা বলতে তাকে বাধ্য করছে।
মানসুর।
জি।
তুমি যদি সত্যি তোমার মানসিক ক্ষমতার কোনো প্ৰমাণ দেখাতে আমি খুশি হতাম। তুমি যা দেখিয়েছ তা হচ্ছে সাধারণ ম্যাজিকের কৌশল। সিগারেট টেবিলের উপর রেখেছ, তারপর মাথা নিচু করে খুব সাবধানে ফুঁ দিয়েছ। তুমি যা দেখিয়েছ তা মানসিক ক্ষমতা না, ফুসফুসের ক্ষমতা।
মনসুর তাকিয়ে আছে। মিসির আলি লক্ষ করলেন, তার চোখ ধক করে জ্বলে উঠেই নিভে গেল। মিসির আলি বললেন, আমি কি ভুল বলেছি?
না।
তুমি তা হলে ওঠো।
আপনার কি এখন কাজ আছে?
আমার এখন কোনো কাজ নেই। কাজ না থাকলেই আমি যে লোকজনের সঙ্গে গল্প করি তা না।
আপনি আমাকে বাসা থেকে বের করে দিচ্ছেন?
তা-ও না। আমি খুব অদ্রভাবে বলার চেষ্টা করছি যে আমি এখন একা থাকতে চাচ্ছি।
আপনার ধারণা আমি একজন ফ্রড, ভাঁওতাবাজ?
তা-ও না। ম্যাজিশিয়ানরা ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে যে ধরনের কথা বলেন তুমিও তাই বলেছ, এতে দোষ ধরার কিছু নেই।
আমার কিন্তু সত্যি সত্যি মানসিক ক্ষমতা আছে। আজ দেখাতে পারলাম না। একদিন এসে দেখিয়ে যাব।
সত্যি ক্ষমতাটা আজ দেখালে তো তোমাকে দ্বিতীয়বার দেখাতে হতো না।
মনসুর চাপা গলায় বলল, সত্যি ক্ষমতা আমি কাউকে দেখাই না। দেখাতে চাইলেও দেখাতে পারি না। বিশেষ বিশেষ সময়ে এই ক্ষমতা আমার মধ্যে আসে। যদি কখনো আসে আপনাকে দেখাব।
ঠিক আছে।
আপনাকে বিরক্ত করার জন্য এবং আপনার সঙ্গে যে মিথ্যা কথা বলেছি সে জন্য আমি দুঃখিত।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
মোটেই ঠিক নেই। সবই বেঠিক। তবে আমি একদিন এসে সব ঠিক করে দিয়ে যাব।
যুবক মাটিতে ফেলে দেয়া তার আধ খাওয়া সিগারেট আবার হাতে নিয়ে ধরাল। তামাকের কটু গন্ধে মাথা ধরে যাবার মতো অবস্থা হল।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। কথাবার্তা পর্ব শেষ হয়েছে এই সিগন্যাল দেয়া হল। এরপরও মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন যুবক নিশ্চয়ই দাড়িয়ে থাকবে না। তার সামান্য চক্ষুলজ্জা থাকলে সে চলে যাবে।
স্যার যাই?
মিসির আলি চোখ খুললেন না। মাথা নাড়লেন। মনসুর চলে যাচ্ছে, চোখ বন্ধ করেও তা বোঝা যাচ্ছে। পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। জুতার শব্দ। মনসুর স্যান্ডেল পরে আসে নি, জুতা পরে এসেছে। কী রকম জুতা, কালো না ব্ৰাউন? কত দিনের পুরোনো জুতা? জুতার ফিতাগুলো কীভাবে বেঁধেছে? জুতার ফিতা বাধা থেকে একজন মানুষের চরিত্র খানিকটা বলে দেয়া যায়! কেউ খুব শক্ত করে ফিতা বাঁধে। কারো ফ্রিতা বাধায় টিলাঢালা ভাব থাকে। মিসির আলি লক্ষ করেন নি।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বদলায়। তিনিও সম্ভবত বদলাচ্ছেন। আগের মতো খুঁটিয়ে কিছু লক্ষ করছেন না। মনসুর একটা চেকশার্ট পরে এসেছে। এটা মনে আছে! সাদা কাপড়ে নীল সবুজ চেক। শার্টের বুক পকেটে একটা ফাউন্টেন পেন ছিল। ফাউন্টেন পেনের কথা মনে আছে।–কারণ আজকাল ফাউন্টেন পেন কেউ ব্যবহার করে না। ফাউন্টেন পেন কেন, বিল পয়েন্ট কলামও কেউ সঙ্গে রাখে না। বল পয়েন্ট কলম, যেখানে যাওয়া যাবে সেখানেই পাওয়া যাবে, কাজেই সঙ্গে রাখার দরকার কী।