মিসির আলি বললেন, না। এখন সুস্থ। বাসায় নিয়ে এসেছি।
এই এক যন্ত্রণা, একশ’ টাকা মাসের কাজের মেয়ে তার চিকিৎসার পেছনে খরচ পাঁচশ’। আমার ঘরে তো অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে। এখন আবার একটার হয়েছে জণ্ডিস। বড় বিপদে আছি।
মিসির আলি বললেন, ব্যাগভর্তি বাজার। আজ কি কোনো উৎসব?
আজমল সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, আপনি বুদ্ধিমান লোক। ঠিকই ধরে ফেলেছেন। রেবুকে আজ দেখতে আসবে। ছেলে সুইডেনে থাকে। ভালো কিছু করে বলে মনে হয় না। লেবার টাইপ। আমি মেয়ে পার করতে পারলেই খুশি। বিদেশে গিয়ে বাথরুমের গু-মুত পরিষ্কার করলে করবে। আমার কি? আপনি আমার নিজের লোক। আপনাকে বলতে অসুবিধা নাই। ওর ইতিহাস ভালো না। শুনলে চমকে উঠবেন। যদি ভালোয় ভালোয় বিয়ে হয়ে যায়, রেবুকে বিদায় করতে পারি, তাহলে দুঃখের কথা বলব। কাউকে বলতে ভালো লাগে না।
বলতে ইচ্ছা না করলে বলবেন না।
আপনাকে তো আমি বলতেই পারি। শুনুন ভাই, আজ রাতে আমাদের সঙ্গে খানা খাবেন। আমিন বাজার থেকে গরুর মাংস কিনেছি। খেলে বুঝবেন কী জিনিস। আসবেন কিন্তু মনে করে। আর একটু খাস দিলে দোয়া করবেন। আমার পীর ভাই বলেছেন, এই বিয়ে হবে। উনি যা বলেন তাই হয়। উনি কিন্তু বলেছেন আর হয় নি তা কখনো হয় নাই। অতি কামেল লোক, উনার কথা মিথ্যা হবে না। বাকি আল্লাহ মালিক। আপনাকে এত চিন্তিত লাগছে কেন? এত চিন্তা করবেন। না। সব আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকেন। রাতে মনে করে খানা খেতে আসবেন।
মিসির আলি বললেন, আজ বরং বাদ থাকুক। বাইরের লোকজন থাকবে। আমি আবার অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে খেতে পারি না।
আজমল সাহেব বললেন, আমারও একই প্রবলেম। আমিও পারি না। আপদরা বিদায় হলে আপনাকে খবর দিব। তারপর দুই ভাই মিলে খানা খাব। এই আমার ফাইনাল কথা।
আজমল সাহেব বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন। মিসির আলি লক্ষ করলেন দোতলার বারান্দায় রেবু এসে দাঁড়িয়েছে। সে একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। রেবুকে একটা প্রশ্ন করবেন বলে তিনি ভেবে রেখেছিলেন। তার সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন আর প্রশ্নটা করা হয় না। আজ অবশ্যই প্রশ্নটা করতে হবে। প্রশ্নটা হিন্দি ছবি নিয়ে। মারামারির দৃশ্যে দেখা গেল নায়কের শার্টের একটা বোতাম নেই। কিন্তু মৃত্যুদৃশ্যে বোতামটা ঠিকই আছে। এর পেছনে রহস্যটা কী?
রসুন ভর্তা জিনিসটা যে এত সুস্বাদু মিসির আলি কল্পনাও করেন নি। তিনি শুধু রসুন ভর্তা দিয়েই এক গামলা ভাত খেয়ে ফেললেন। আঁখিতারার দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ থেকে আমি তোমার নাম দিলাম কুটু মিয়া।
কুটু মিয়া কে?
কুটু মিয়া একটা উপন্যাসের চরিত্র। তার মতো রান্না কেউ করতে পারে না।
আঁখিতারা আনন্দে নুয়ে পড়ল। মিসির আলি বললেন, এখন তুমি আমাকে বলো, তুমি যে রাতে জ্বিনকে দেখলে সেই জিন কী করল?
চিমটি দিছে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিমটি দিল না বসে চিমটি দিল?
বসছে। তারপরে চিমটি দিছে।
ভূত চিমটি দেয় আমি কোনোদিন শুনি নি। চিমটি দেয় মেয়েরা।
আঁখিতারা গম্ভীর গলায় বলল, আমারে চিমটি দিছে জিনে।
মিসির আলি বললেন, এখন তো আর চিমটি দিতে পারবে না। গলায় তাবিজ। ঠিক নয়?
হুঁ।
তোমার চৌকিটা আমি আমার ঘরে ঢুকিয়ে ফেলব। জিন যদি আসে তুমি আমাকে ডাকবে।
আনন্দে অভিভূত হয়ে আঁখিতারা ডান দিকে ঘাড় কাত করল। মিসির আলির মনে হলো বাচ্চা এই মেয়েটির জীবনে যে ক’টি আনন্দময় ঘটনা ঘটেছে আজকের এই সিদ্ধান্ত তার একটি।
আঁখিতারা।
জি।
মন দিয়ে শোনো, ভবিষ্যতে তুমি যতবার রান্না করবে একটা আইটেম যেন অবশ্যই থাকে। রসুন ভর্তা।
আঁখিতারা আবার ঘাড় কাত করল। তার এতই আনন্দ হচ্ছে যে, কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা করছে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না একটা মানুষ এত ভালো হয় কীভাবে? সামান্য কিছু মন্দ তো মানুষের মধ্যে থাকতে হবে। যদি না থাকে তাহলে মানুষ আর ফেরেশতায় তফাৎ কী?
আঁখিতারা!
জি।
তুমি লেখাপড়া জানো?
না।
লেখাপড়া শিখতে হবে। রসুন ভর্তা বানালে হবে না। আমি তোমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব।
আঁখিতারা ঘাড় কাত করল। এইবার সে আর চোখের পানি আটকাতে পারল না। তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।
মিসির আলি তাকিয়ে দেখলেন। কিছু বললেন না। তিনি চাচ্ছেন মেয়েটা আরো কাদুক। আনন্দের কান্না দেখতে তাঁর বড় ভালো লাগে।
আঁখিতারা।
জি।
খাওয়া শেষ করে আমার মাথায় তেল দিয়ে দাও। তুমি আমার অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছ। রসুন ভর্তা দিয়ে যে খাওয়া খেয়েছি আজ দুপুরে না ঘুমুলে চলবে না। আজ আমি মড়ার মতো ঘুমাব।
মিসির আলি সত্যি সত্যি মড়ার মতো ঘুমালেন। তার ঘুম ভাঙল রাত ন’টায়। দিনের বেলায় এত লম্বা ঘুম তিনি তাঁর জীবনে আর কখনো ঘুমিয়েছেন বলে মনে করতে পারলেন না। মৃত্যুর কাছাকাছি ঘুম। শান্তি এবং তৃপ্তির ঘুম। সবকিছুরই কারণ আছে। তৃপ্তিময় দীর্ঘ ঘুমেরও নিশ্চয়ই কারণ আছে। সব সময় কারণ খুঁজতে ভালো লাগে না। তিনি হাত-মুখ ধুতে গেলেন। রাতে আজমল সাহেবের বাড়িতে খেতে যেতে হবে। আঁখিতারাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। মেয়েটাকে অবশ্যই একা রেখে যাওয়া যাবে না। জিনবিষয়ক ভীতি মেয়েটার মাথার ভিতর আছে। যে কোনো সুযোগে আবার সেই ভয় ডালপালা মেলতে পারে।
আঁখিতারা বলল, বড় বাবা, চা খাইবেন?
মিসির আলি বললেন, না। দাওয়াত খেতে যাব। তুমিও সঙ্গে যাবে।
আঁখিতারা বলল, আপনের কি শইল খারাপ?