আগন্তুক পুরুষ না রমণী তার মীমাংসা হবার আগেই মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যেই বিচিত্র স্বপ্ন দেখলেন।
আঁখিতারা বাসায় ফিরেছে
আঁখিতারা বাসায় ফিরেছে। তার গলায় দুটা তাবিজ। মিসির আলি কাকরাইল মসজিদের সামনের ফুটপাতের দোকান থেকে তাবিজ দুটা কিনেছেন। আঁখিতারা খুবই আগ্রহের সঙ্গে গলায় তাবিজ পরে ঘুরছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে অনেক দিন পর বাবার বাড়িতে ফিরে আনন্দে আত্মহারা। মেয়েটাের আনন্দ দেখে মিসির আলির ভালো লাগছে।
আঁখিতারা বলল, বড় বাবা, চা বানায়ে দিব?
মিসির আলি বললেন, দাও।
দুপুরে রান্ধা কী হইব? ঘরে বাজার নাই।
ডাল-ভাত করে। ঘন ঘন বাজারে যেতে আমার ভালো লাগে না।
রসুন ভর্তা করব? রসুন ভর্তা খাইবেন? রসুন আর শুকনা করিচ পুড়াইয়া ভর্তা বানাইতে হয়। খাইবেন?
হুঁ, খাব।
মিসির আলির মনে হলো হাসপাতাল থেকে ফিরে আঁখিতারার মুখে বুলি ফুটেছে। মেয়েটা ফটফট করে কথা বলছে। ‘পোস্টমাস্টার’-এর রতনের সঙ্গে এই মেয়ের ভালোই মিল আছে। রতনও ছিল ফটফটানি মেয়ে।
চা বানিয়ে মিসির আলির সামনে রাখতে রাখতে আঁখিতারা বলল, বড় বাবা, চাইরটা ঘর-বন্ধন তাবিজ ঘরের চাইর কোনায় লটকাইয়া দিলে ঘরে কিছু ঢুকব না।
ঘর-বন্ধন তাবিজ কোথায় পাওয়া যায়?
আমরার দেশের মৌলানা সাব ঘর-বন্ধন তাবিজ দেন।
তুমি যখন দেশে যাবে, তখন আমার জন্য ঘর-বন্ধন তাবিজ নিয়ে এসো।
আইচ্ছা।
আঁখিতারা, শোনো, আজ তোমার এত কাজকর্ম করার দরকার নেই। হাসপাতাল থেকে এসেছি। বিশ্রাম করো। খাবার আমি হোটেল থেকে আনিয়ে নেব।
আমার অন্ত বিশ্রামের দরকার নাই। অনেক বিশ্রাম হইছে।
মিসির আলি চায়ের কাপ নিয়ে বসার ঘরে বেতের চেয়ারে বসলেন। তিনি সেখান থেকেই আঁখিতারার প্রবল বেগে ঘর বাট দেবার শব্দ শুনলেন। মেয়েটার কাণ্ডকারখানায় তিনি বেশ আনন্দ পাচ্ছেন।
মিসির আলির আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর ভ্ৰ কুঁচকে গেল। সিগারেটে টান দিয়ে আনাড়ি সিগারেটখোরদের মতো খকখক করে কাশতে লাগলেন। কোনো কারণে তার মনে যদি খটকা তৈরি হয়, তখন এই ব্যাপারটা ঘটে। সিগারেটে টান দিয়ে কাশতে শুরু করেন। আজকের এই খটকা তৈরি হয়েছে মনসুরের চিঠির কারণে। মনসুর এই চিঠি ডাকে পাঠায়নি। খামে বন্ধ করে দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।
পরম শ্ৰদ্ধেয় স্যার
জনাব মিসির আলি।
স্যার, আমি আপনার সঙ্গে পরপর কয়েকটি অন্যায় করেছি। অন্যায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার কারণে আপনাকে লিখছি। হয়তোবা আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।
আমার প্রথম অন্যায় থার্মোমিটার আনার কথা বলে আমি চলে গিয়েছিলাম, আর ফিরে আসি নি। এই অন্যায়টি কেন করেছি আপনার মতো বুদ্ধিমান মানুষের তা না বোঝার কোনো কারণ নেই। স্যার, আমি থার্মোমিটার দিয়ে কোনো ম্যাজিক দেখাতে পারি না। থার্মেমিটার নিয়ে উপস্থিত হলে ম্যাজিক দেখাতে হতো। কাজেই আমি পালিয়ে চলে গেছি।
আপনি আমার কাজকর্মে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। সন্দেহভাজন একজন মানুষ যত ভালো কাজই করুক তার কাজকে দেখা হয় সন্দেহের চোখে।
আপনি যখন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো আঁখিতারাকে চেনো না, তাহলে তার নাম কীভাবে জানলে? আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবার কারণে তৎক্ষণাৎ জবাব দিলাম না। কী করে তার নাম জানি আর কেনইবা আমি পকেটে থার্মোমিটার নিয়ে ঘুরছিলাম সেটা বলি। আপনার কাছে জোড়হাতে অনুরোধ করি, আমার কথাগুলি দয়া করে পড়ুন। হয়তোবা আপনি আমার বিচিত্র কর্মকাণ্ড বুঝতে পারবেন।
ওইদিন আঁখিতারা মেয়েটি প্রবল জুরে ছটফট করছিল। আমি তখন এসেছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আপনার ঘরের দরজা বেশিরভাগ সময়ই খোলা থাকে। আমি ঢুকে গেলাম আপনার বসার ঘরে। সেখান থেকে শুনলাম। আপনি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলছেন। মেয়েটার প্রবল জ্বর তাও বুঝলাম। আমি আপনাকে চমকে দেবার জন্যই ঘর থেকে বের হয়ে ফার্মেসিতে চলে গেলাম। জ্বর কমানোর অষুধ প্যারসিটামল কিনলাম। আপনার বাসায় থার্মোমিটার নাও থাকতে পারে, এই ভেবে একটা থার্মোমিটারও কিনলাম। স্যার, আমি যে সত্যি কথা বলছি তা কি বিশ্বাস করছেন? যদি বিশ্বাস করেন তাহলে আরেকটা সত্যি কথা বলি। রেবু (রাবেয়া) নামের মেয়েটা তার স্বামী ও সন্তানকে হত্যা করেছে–এই ঘটনাটাও সত্যি। মেয়েটা সাইকোপ্যাথিক! সে তার পছন্দের মানুষদের খুন করে। আমি জানি আপনি তার পছন্দের মানুষদের একজন। একই ঘটনা আপনার ক্ষেত্রেও ঘটতে যাচ্ছে। আপনি অতি বুদ্ধিমান মানুষ হয়েও ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না। এইখানেই আমার দুঃখ।
স্যার, আমার কথা। আপনি যদি বিশ্বাস নাও করেন, একটু সাবধানে থাকবেন। আমার মন বলছে কোনো এক গভীর রাতে সে আপনার ঘরে ঢুকে পড়বে। হয়তোবা ইতিমধ্যেই ঢুকেছে।
ইতি চৌধুরী খালেকুজ্জামান।
চিঠি শেষ করে মিসির আলি সিগারেটে টান দিয়ে আবারও খকখক করে কাশতে লাগলেন। আঁখিতারা বলল, বড় বাবা, আপনারে আরেক কাপ চা দিব?
মিসির আলি বললেন, দাও।
চা সে বানিয়েই রেখেছিল। মিসির আলির কথা শেষ হবার আগেই সে চায়ের কাপ নিয়ে উপস্থিত হলো। মিসির আলি কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। আজমল সাহেব ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে রিকশা করে ফিরছিলেন। মিসির আলিকে দেখে বললেন, আপনার কাজের মেয়েটার কী হয়েছে? হাসপাতালে নাকি ভর্তি করিয়েছেন? ডেঙ্গু-ফেঙ্গু নাকি?