রেবু বলল, আমি একবার পরীক্ষার হলে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জিওগ্রাফি ফাইনাল পরীক্ষার দিন। সারারাত জেগে পড়েছি। হলে বসার পর লক্ষ করলাম। এমন ঘুম ধরেছে, চোখ মেলে রাখতে পারছি না। টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। ইনভিজিলেটর আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। সেই থেকে আমার নাম হয়ে গেল ঘুম রাবেয়া। আমাদের ক্লাসে দু’জন রাবেয়া ছিল। একজন খুব নামাজ পড়ত। বোরকা পরে স্কুলে আসত। তাকে সবাই ডাকত তাপসী রাবেয়া, আমাকে ডাকত ঘুম রাবেয়া।
মিসির আলি বললেন, তোমার নাম রাবেয়া?
হুঁ। শুধু রাবেয়া না। ঘুম রাবেয়া।
তোমার ভালো নাম শেফালী না?
না তো! আমি কি কখনো আপনাকে বলেছি আমার নাম শেফালী? তবে আপনার যদি আমাকে শেফালী ডাকতে ভালো লাগে আপনি ডাকতে পারেন। আমি রাগ করব না। আপনার কোনো কিছুতেই আমি রাগ করব না।
রেবু আজ শাড়ি পরে আসে নি। সালোয়ার-কামিজ পরেছে। পোশাকের জন্যই হয়তো তাকে কিশোরীদের মতো লাগছে। শাড়ি না পরার কারণে তার মধ্যে এখন তরুণী ভাব একেবারেই নেই। শাড়ি অদ্ভুত একটা পোশাক। ছেলেদের এমন কোনো পোশাক নেই। যা পরলে একটা কিশোরকে যুবক মনে হবে। মিসির আলির মনে হলো শাড়ি নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। বারো-তেরো হাত লম্বা একটা কাপড় কেন একজন কিশোরীকে তরুণী বানিয়ে দেবে?
রেবু বলল, আপনি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
কীভাবে তাকিয়ে আছি?
মনে হচ্ছে আপনি আমার কথা শুনে খুবই অবাক হচ্ছেন।
তোমার ভালো নাম রাবেয়া এটা শুনে অবাক হচ্ছি।
কেন? মানুষের ভালো নাম রাবেয়া থাকতে পারে না?
অবশ্যই পারে। তোমার নাম তো শুধু রাবেয়া না, তোমার নাম ঘুম রাবেয়া।
আমি খুব মজা করে গল্প করতে পারি, তাই না?
হুঁ।
যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে সে আমার গল্প শুনে খুব মজা পাবে। আগে আরো মজা করে গল্প করতে পারতাম। অসুখের পর আগের মতো মজা করে গল্প করতে পারি না। আপনার তো খুব বুদ্ধি, বলুন তো কেন আগের মতো মজা করে গল্প করতে পারি না?
বলতে পারছি না। তুমিই বলো?
যখনই কারো সঙ্গে গল্প করি তখনই মনে হয়। সে বুঝে ফেলছে আমার মাথা পুরোপুরি ঠিক নেই। তখন সাবধান হয়ে যাই। সাবধান হয়ে কথা বললে কি আর গল্পের মধ্যে মজা থাকে?
মিসির আলি বললেন, থাকে না।
রেবু গলার স্বর নামিয়ে বলল, আপনি কি জানেন, আপনার এখানে আসা আমার জন্য পুরোপুরি নিষেধ হয়ে গেছে?
না, জানি না।
আমার ওপর সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। মামা বলে দিয়েছে। আর কোনোদিনও যেন আপনার এখানে না আসি।
নিষেধ অমান্য করে এসেছ, তোমার মামা তো রাগ করবেন।
মামা জানতে পারলে তবেই না রাগ করবে। আজ বৃহস্পতিবার না?
বৃহস্পতিবার কী?
বৃহস্পতিবারে মামার পীর ভাই আসে। মামা সন্ধ্যার পর থেকে ছাদের ঘরে চলে যায়। জিকির করে। সারারাত ছাদের ঘরে থাকে। নামে না।
বলতে বলতে রেবু খিলখিল করে হেসে ফেলল। মিসির আলি বললেন, হাসছ কেন?
রাবেয়া হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, কারণটা আপনাকে বলব না। আচ্ছা শুনুন, আপনার কি জ্বর?
না।
আমার মনে হয় আপনার জ্বর। জ্বর হলে আপনার খুব কষ্ট হয়, তাই না? সেবা করার কেউ নেই। অসুখ-বিসুখ হলে সেবা পেতে খুব ভালো লাগে। ঠিক বলেছি না?
মিসির আলি জবাব দিলেন না। মেয়েটির সঙ্গে এখন আর কথা বলতে ভালো লাগছে না। তাকে হাসপাতালে যেতে হবে। হঠাৎ করেই তার মনে হচ্ছে আঁখিতারার শরীর ভালো না। তার কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে। মিসির আলি বললেন, রেবু আমি এখন একটু বের হব।
আচ্ছা, আমি চলে যাচ্ছি। আপনি কিন্তু আর কখনো দরজা খোলা রেখে ঘর অন্ধকার করে বসে থাকবেন না।
রেবু চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মিসির আলি বাতি নিভিয়ে দিলেন। ছোট্ট হিসাবটা এখনো মেলে নি। বাতি নেভানোর পর যদি মেলে। একটা উত্তর তার কাছে আছে। উত্তরটা গ্রহণযোগ্য না। গ্রহণযোগ্য না এমন উত্তরও অনেক সময় সঠিক হয়। রেবুকে জিজ্ঞেস করে উত্তরটা যাচাই করে নেওয়া যেত। কিন্তু রেবুর কথাবার্তায় তাঁর সংশয় আছে। সে মানসিকভাবে সুস্থ না। তার কোনো কথাই গ্রহণযোগ্য না।
মিসির আলি খাট থেকে নামলেন। তার শরীর খারাপ লাগছিল। শরীর খারাপের কারণ ধরতে পারছিলেন না। খাট থেকে নামার পর শরীর খারাপের কারণ ধরতে পারলেন। আজ সারা দিন তার খাওয়া হয় নি।
রিকশায় উঠে মিসির আলির ক্ষুধাবোধ চলে গেল। তাঁর মনেই রইল না। রিকশায় ওঠার আগ পর্যন্ত তিনি ভেবে রেখেছিলেন আলি মিয়ার রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খেয়ে নেবেন। তাঁর যখন রান্না করতে ইচ্ছা করে না। তখন এই রেস্টুরেন্টে খেতে যান। বিচিত্র কারণে রেস্টুরেন্টের মালিক চান মিয়া তাঁকে অসম্ভব পছন্দ করে। তাঁকে দেখলেই হাসিমুখে বলেন, বাবুরে খানা দে। ঠিকমতো দিবি। আগে টেবিল সাফা কর। টেবিলে যেন আর কেউ না বসে।
চান মিয়া কেন তাকে বাবু ডাকে, কেনইবা তার জন্য এতটা ব্যস্ত হয় তা তিনি জানেন না। জিজ্ঞেসও করেন নি। প্রশ্ন করে কারণ জানতে তার ভালো লাগে না। কোনো একদিন কারণটা নিজেই ধরতে পারবেন। আর ধরতে না পারলেও ক্ষতি নেই। কারণ ধরতেই হবে এমন কথা নেই।
আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যে কোনো মুহুর্তে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি নামার আগে আগে প্রকৃতি কিছু বোধ হয় করে। চারদিকে এক ধরনের অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয়।
রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমারও কি অস্থির লাগছে?