আমি বলি নি তুমি খারাপ লোক। আমার কাজের মেয়েটার নাম যে আঁখিতারা এটা কীভাবে জানলে?
মনসুর তাকিয়ে আছে। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। মনে হচ্ছে না। এই প্রশ্নের জবাব সে দেবে।
মিসির আলি বললেন, মেয়েটার জন্য থার্মোমিটার আনার কথা বলে তুমি দৌড় দিয়ে বের হলো। থার্মোমিটার তোমার পকেটেই ছিল। তুমি কি থার্মোমিটার পকেটে নিয়ে চলাফেরা করে?
জি।
কেন?
থার্মোমিটার দিয়ে আমি একটা মেন্টাল ম্যাজিক দেখাই। থার্মোমিটারের দিকে তাকিয়ে থেকে আমি থার্মোমিটারের পারদ ওপরে উঠাতে পারি। আপনাকে এটা দেখাব বলে থার্মোমিটার সঙ্গে করে এনেছিলাম।
দেখি তোমার এই খেলাটা।
থার্মোমিটার। আপনার বাসায় রেখে এসেছি। আপনি সত্যি দেখতে চান?
হ্যাঁ, দেখতে চাই।
আমি থার্মোমিটার একটা কিনে নিয়ে আসি। দু’মিনিট লাগবে। আপনি আরেক কাপ চা নিন। চা শেষ করার আগেই আমি চলে আসব।
মিসির আলি দ্বিতীয় কাপ চা শেষ করার পরেও আরো আধঘণ্টা বসে রইলেন। মনসুর ফিরল না। আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। আঁখিতারার খোঁজ নেওয়ার জন্য হাসপাতালে যাওয়া দরকার। মনসুরকে নিয়ে এই মুহুর্তে কিছু না ভাবলেও চলবে। মিসির আলি চায়ের দাম দিতে গেলেন। রেস্টুরেন্টের মালিক খুবই অবাক হয়ে বলল, আপনে ময়না ভাইয়ের লোক, আপনার কাছে থাইক্যা চায়ের দাম নিব এইটা কেমন কথা!
ময়না ভাই এই মানুষটার কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কেন গুরুত্বপূর্ণ কে জানে। জানতে ইচ্ছা করছে না। কোনো সমস্যা মাথার ভেতর ঘুরপাক থাক তা চাচ্ছেন না। তাঁর নিজেরই শরীর খারাপ লাগছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে শুয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলে ভালো হতো।
মিসির আলি তাঁর ঘরে
রাত প্ৰায় আটটা। মিসির আলি তাঁর ঘরে। ঘরের কোনো বাতি জ্বালানো হয় নি। এতক্ষণ অন্ধকারেই হাঁটাহাঁটি করছিলেন। বসার ঘর থেকে রান্নাঘরে যাওয়া, রান্নাঘর থেকে আবার বসার ঘর। জায়গাটা খুব ভালো করে চেনা। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে না। অন্ধকারে কেন হাঁটাহাঁটি করছেন তা তিনি জানেন না। অস্থিরতা কাটানোর কোনো চেষ্টা হতে পারে। অস্থিরতা কাটানোর এই প্রক্রিয়া মিসির আলির চরিত্রের সঙ্গে মানাচ্ছে না। খুব অস্থির অবস্থায় তিনি চুপচাপ বসে থাকেন।
আঁখিতারাকে নিয়ে তিনি হঠাৎ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। মনে হচ্ছে মনসুরের কথা ঠিক। মেয়েটা বাঁচবে না। অথচ হাসপাতালের ডাক্তার বলে দিয়েছেন ভয়ের কিছু নেই। এশিয়া জোনে ভাইরাসের নতুন কিছু ষ্ট্রেইন দেখা দিয়েছে। এতে হাই ফিভার হয়। ডেঙ্গু তার মধ্যে একটা।
মিসির আলি ডাক্তারকে বললেন, মেয়েটার কি ডেঙ্গু হয়েছে?
ডাক্তার সাহেব ভরসা দেয়ার মতো গলায় বললেন, হতে পারে। তবে চার-পাঁচদিন পার না হলে কিছুই বলা যাবে না। আমরা সিস্টেমেটিক চিকিৎসা চালিয়ে যাব। আপনি নিশ্চিত থাকুন।
ডাক্তারের কথায় তাঁর ভরসা পাওয়া উচিত। ভরসা পাচ্ছেন না। ভরসা না পাওয়ার কারণ কি মনসুর? সে পীর-দরবেশের মতো বলে বসিল মেয়েটা বাঁচবে না। সে কোনো পীর-দরবেশ না। পীর-দরবেশদেরও মানুষের মৃত্যু নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা থাকে বলে তিনি মনে করেন না। তারপরেও কি কোনো কারণে মনসুরের কথা তার মনের গভীরে ঢুকে গেছে। হিপনোটিক সাজেশান?
আচ্ছা বাড়িওয়ালার পীর ভাই-এর এখানে কোনো ভূমিকা আছে! এই মানুষটিও তো ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন–মহাবিপদ আসছে। জীবন সংশয় হবার মতো বিপদ। তাই তো হয়েছে। শুধু জীবন সংশয়টা তার না হয়ে আঁখিতারার হয়েছে।
মিসির আলি হাঁটাহাঁটি বন্ধ করে খাটে উঠে বসলেন। এখনো বাতি জ্বালাতে ইচ্ছা করছে না। একটা ছোট্ট হিসাব মিলছে না। তিনি ঠিক করলেন ছোট্ট হিসাবটা না মেলা পর্যন্ত তিনি বাতি জ্বালাবেন না। হিসাব মেলানোর জন্য তিনি তাড়াহুড়ো করে হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। এখন মনে হচ্ছে ফেরা ঠিক হয় নি।
হাসপাতালে মেয়েটার পাশে থাকা উচিত ছিল। মেয়েটার মা-বাবা মেয়েটাকে হাসপাতালে ফেলে রেখে চলে আসতে পারত না। তার বিছানার পাশে সারা রাত জেগে বসে থাকত।
বেচারি আঁখিতারা প্রবল জুরের ঘোরে আশপাশে অপরিচিত মানুষজন দেখবে, নার্স দেখবে, ডাক্তার দেখবে। কাউকেই সে চিনতে পারবে না। কী প্ৰচণ্ড ভয়ই না সে পাবে। কী করে তিনি মেয়েটাকে ফেলে চলে এলেন?
মিসির আলি ঠিক করলেন রাতের খাবার খেয়ে আবার হাসপাতালে ফিরে যাবেন। থাকবেন মেয়েটার পাশে। যত বার সে চোখ মেলবে তত বার তিনি বলবেন, ভয় পেও না, আমি আছি। ভালো হয়ে যাও। এক ধরনের হিপনোটিক সাজেশান দেওয়া হবে। মেয়েটা এই সাজেশানের মর্ম বুঝতে পারবে না। তাতে কোনো ক্ষতি নেই।
আপনি ঘর অন্ধকার করে বসে আছেন কেন?
মিসির আলি চমকে উঠে বললেন, কে?
কী আশ্চৰ্য, আমার গলা চিনতে পারছেন না। আমি রেবু। আপনার সুইচবোর্ড কোনদিকে বলুন তো। আমি বাতি জ্বেলে দেই।
মিসির আলি খাটে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। তার হাতের কাছেই সুইচবোর্ড। তিনি সুইচ টিপলেন। রেবু বলল, আপনার দরজা খোলা, ঘর অন্ধকার। আমি ভাবলাম চোর এসে দরজা খুলে সবকিছু নিয়ে গেছে। কি কি নিয়েছে তা দেখার জন্যে এসেছিলাম। আপনি ঘর অন্ধকার করে বসে ছিলেন কেন? আপনি কি বসে বসে ঘুমুচ্ছিলেন।
মিসির আলি জবাব দিলেন না। জবাব দেবার কিছু নেই। তিনি কি বলবেন, না, আমি বসে বসে ঘুমুচ্ছিলাম না।