কোনো ব্যাখ্যা করতে হবে না। তুমি মেয়েটকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করে।
এক কাপ চা খেয়ে নেই। স্যার? পাঁচ মিনিট লাগবে। পানি গরম দিয়েছি। আপনি আরেক কাপ খাবেন?
মিসির আলি জবাব দিলেন না।
তিনি মনসুরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।
আঁখিতারাকে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর ডাক্তার এনে সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে দেখানোর ব্যবস্থা মনসুর অতি দ্রুত করে ফেলল। মিসির আলি তার কর্মক্ষমতার প্রশংসা না করে পারলেন না। সব কিছুই যেন তার হাতের মুঠোয়। সিস্টারদের সঙ্গে হাসিমুখে আপা আপা করে কথা বলছে। যেন কত দীর্ঘদিনের পরিচয়। এক ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার সময় ডাক্তারের বাড়ি মাদারীপুর শুনে মনসুর এমন ভঙ্গি করল যেন মাদারীপুর বাড়ি হওয়াটা বিস্ময়কর ঘটনা। এমন বিস্ময়কর ঘটনা শতাব্দীতে একটা-দুটার বেশি ঘটে না। গলা অন্যরকম করে সে দু’বার বলল ও, আচ্ছা আপনার বাড়ি মাদারীপুর। বলেন কি!
মিসির আলি হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়েটা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তিনি খানিকটা স্বস্তি পাচ্ছেন। চিকিৎসা শুরু হবে। ডাক্তাররা দেখবেন। দেশের ডাক্তারদের প্রতি তাঁর আস্থা আছে। আস্থার পেছনের লজিক হচ্ছে। এ দেশের সব ডাক্তারকেই অসংখ্য রোগী দেখতে হয়। রোগীর প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টের ওপর ডাক্তাররা তেমন ভরসা করেন না। কারণ প্যাথলজিক্যাল ল্যাবগুলির অবস্থা তারা জানেন। ডাক্তারদের নির্ভর করতে হয় অভিজ্ঞতার ওপর। লক্ষণ বিচার করে রোগ নির্ণয়ে তাদের দক্ষতা অসামান্য।
সব কমপ্লিট করে দিয়ে এসেছি স্যার।
বলতে বলতে সিগারেট হাতে মনসুর এসে তার সামনে দাঁড়াল। তাকে কেমন যেন হাসি-খুশি মনে হচ্ছে।
মনসুর সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, রোগীর যদি কিছু হয়ে যায় কেউ আমাদের দোষ দিতে পারবে না। আমরা প্রপার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। আমাদের দিক থেকে কোনো ভুল নেই। রোগীর মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে।
মিসির আলি বললেন, তুমি বারবার মৃত্যুর প্রসঙ্গ আনিছ কেন? মৃত্যু কেন হবে?
মানুষ তো স্যার অমর না। মানুষের মৃত্যু হয়। মানুষ মরণশীল।
তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
বলুন।
মিসির আলি বললেন, তুমি এত নিশ্চিত কীভাবে যে মেয়েটা মারা যাবে?
সব মানুষের মৃত্যুর ব্যাপারেই আমি নিশ্চিত। তবে আঁখিতারার মৃত্যু যে ঘনিয়ে এসেছে এটা বুঝতে পারছি।
আঁখিতারা মেয়েটাকে তুমি চিনতে?
জি না। আমি চিনিব কী করে? সে কাজ করে আপনার এখানে।
মিসির আলি বললেন, চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়া কি তোমার আসল নাম? নাকি এটাও ছদ্মনাম?
চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়া?
হ্যাঁ, চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়া।
মনসুর সিগারেটে ঘন ঘন কয়েকটা টান দিয়ে সিগারেট ছুড়ে ফেলে সেই দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমার এই নাম আপনি কীভাবে জানলেন?
মিসির আলি বললেন, একেকজনের পদ্ধতি একেক রকম। তুমি একটা পদ্ধতিতে বের করেছ যে আঁখিতারা আজ রাতে মারা যাবে। আমি অন্য পদ্ধতিতে তোমার নাম-ধাম-পরিচয় বের করেছি। দু’জনের পদ্ধতি দু’রকম।
আমার নাম-ধাম-পরিচয় বের করেছেন?
হ্যাঁ, বের করেছি। আমার কথা কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে?
বিশ্বাস হচ্ছে। স্যার, আসুন আমরা কোথাও বসে চা খাই। রেস্টুরেন্টে বসে চা খেতে কি আপনার আপত্তি আছে।
না, আপত্তি নেই।
মনসুর বলল, আমার নাম যে চৌধুরী খালেকুজ্জামান এই তথ্য আপনাকে কে দিল?
মিসির আলি বললেন, তুমিই দিয়েছ! অন্য কেউ দেয় নি।
আমি দিয়েছি?
হ্যাঁ তুমি দিয়েছ। কিভাবে দিয়েছ। শুনতে চাও?
না।
হাসপাতালের কাছাকাছি একটা চায়ের দোকানে দু’জন ঢুকল। চায়ের দোকানের মালিক মনসুরের দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, আরে ময়না ভাই। কেমন আছেন?
মনসুর জবাব দিল না। একবার শুধু আড়চোখে মিসির আলিকে দেখল। চৌধুরী খালেকুজ্জামানের আরেক নাম ময়না এটা জেনে মিসির আলির তেমন কোনো ভাবান্তর হলো না। রেস্টুরেন্ট ফাঁকা। যে তিনজন খদের চা-পাউরুটি খাচ্ছে তারা রেস্টুরেন্টের বাইরে বেঞ্চিতে বসে আছে। ভেতরে মানুষ বলতে তারা দু’জন এবং সাত-আট বছরের একটা ছেলে। ছেলেটা বেঞ্চির ওপর কান্নাকান্না মুখ করে বসে আছে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে মালিকের ছেলে। কোনো অপরাধ করায় কিছুক্ষণ আগে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তখন কান্নাকাটি করেছিল। চোখে পানির দাগ রয়ে গেছে। মিসির আলি আগ্রহ নিয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
দোকানের চা ভালো। এই ব্যাপারটা মিসির আলির খুব অদ্ভুত লাগে। নামিদামি রেস্টুরেন্টের চায়ের চেয়ে রাস্তার পাশের সস্তা দোকানগুলোর চা ভালো হয়। সম্ভবত চা বানানোর কোনো বিশেষ কায়দা আছে। বিশেষ কায়দাটা শিখে নিতে হবে।
মনসুর বলল, স্যার, আপনি মনে হয় ধরেই নিয়েছেন। আমি খারাপ লোক।
মিসির আলি বললেন, আমি আগেভাগে কিছু ধরে নেই না। তুমি আমার কাছে আসল নাম গোপন করেছ। নাম গোপন করলেই মানুষ খারাপ হয়ে যায় না। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মানুষ নাম গোপন করতে ভালোবাসতেন। অন্য কোনো পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করতে চাইতেন। এই অস্বাভাবিকতা অনেকের ভেতর আছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের নাম গোপন করে নাম নিয়েছেন নীল লোহিত। বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়ের আরেক নাম বনফুল।
মনসুর বলল, স্যার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় না, বলাই চাঁদও না। তবে আমি খারাপ লোক না।