দরজার কড়া নড়ছে। কেউ একজন এসেছে। মিসির আলি স্বস্তিবোধ করলেন। যে এসেছে তার সঙ্গে পরামর্শ করা যাবে। বিপদের সময় নিজের বুদ্ধির ওপর মানুষের আস্থা কমে যায়। সে অন্যের বুদ্ধির দিকে তাকিয়ে থাকে।
কড়া নাড়ছিল মনসুর।
মিসির আলি দরজা খুলতেই সে বলল, জ্বর কার?
মিসির আলি বললেন, আমার একটা কাজের মেয়ে আছে, নাম আঁখিতারা। তার অসুখ। মিসির আলির একবারও মনে হলো না মনসুরের জানার কথা না জ্বর কার। প্রশ্নটা সে করল কীভাবে?
মনসুর বলল, জ্বর কি বেশি?
অনেক বেশি। কী করা যায় বলো তো?
মনসুর বলল, আপনি অস্থির হবেন না। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।
মিসির আলি স্বস্তির সঙ্গে লক্ষ করলেন মনসুর ছেলেটা কাজের। সে অতিদ্রুত মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করল। পাঞ্জাবির পকেট থেকে একপাতা প্যারাসিটামল বের করে দুটা টেবলেট খাইয়ে দিল। মিসির আলি বললেন, তুমি অষুধ পকেটে নিয়ে ঘোরো নাকি?
মনসুর বলল, আমার মাথাধরা রোগ আছে। যখন-তখন মাথা ধরে। সঙ্গে অষুধ রাখতে হয়। স্যার, আপনার ঘরে কি থার্মোমিটার আছে?
না।
জ্বরটা দেখা দরকার। আপনি মাথায় পানি ঢালতে থাকুন, আমি চট করে একটা থার্মোমিটার কিনে নিয়ে আসি।
মনসুর ঘর থেকে বের হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই থার্মোমিটার নিয়ে ফিরে এলো। জ্বর মাপা হলো। একশ’ পাঁচ।
কারোর জ্বর একশ’ পাঁচ হতে পারে তা মিসির আলির ধারণার মধ্যেও নেই। মেয়েটির মুখ ছাইবৰ্ণ হয়ে গেছে। চোখ লাল টকটক করছে। মিসির আলি বললেন, মনসুর, এখন আমাদের করণীয় কী?
মনসুর বলল, আপনার করণীয় হলো চুপচাপ বসে থাকা। আমি বাকিটা দেখছি। সামান্য অসুখে এতটা নাৰ্ভাস হতে আমি কাউকে দেখিনি।
একশ’ পাঁচ জ্বর, এটাকে তুমি সামান্য বলছ?
ভাইরাসের জ্বর ধুমধাম করে বাড়ে। বাচ্চারা সামাল দিতে পারে। বয়স্ক মানুষের জন্য অসুবিধা হয়। স্যার, আপনি বসার ঘরে চুপচাপ বসে থাকুন। আমি যা করার করছি।
তুমি কী করবে?
প্ৰথমে আপনাকে কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াব। তারপর মেয়েটাকে বাথরুমে নিয়ে যাব। মাথায় চার-পাঁচ বালতি পানি ঢালব।
আমাকে চা খাওয়াতে হবে না। তুমি একজন ডাক্তার ডেকে আনো।
সকালে কোনো ডাক্তার পাওয়া যায় না। ডাক্তাররা প্ৰাইভেট রোগী দেখতে শুরু করেন বিকেলে। আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি আঁখিতারার জ্বর নামিয়ে দিচ্ছি। বিকেলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। আপনি সিগারেট টানতে থাকুন। আমি এক ফাঁকে চা বানিয়ে দিয়ে যাব।
মিসির আলি বসার ঘরে এসে সিগারেট ধরালেন। মেয়েটাকে বাথরুমে নেওয়া হয়েছে এবং তার মাথায় বালতি বালতি পানি ঢালা হচ্ছে। একেকবার পানি ঢালা হচ্ছে মেয়েটা আর্তনাদের মতো করছে। মিসির আলি চমকে চমকে উঠছেন।
স্যার, চা নিন।
পানি ঢালার ফাঁকে ফাঁকে মনসুর চা বানিয়ে ফেলেছে। ছেলেটার কাজ করার ক্ষমতা আছে। মিসির আলি বললেন, জ্বর কি কিছু কমেছে?
মনসুর বলল, এখনো থার্মোমিটার দিয়ে মাপি নি। তবে কিছু নিশ্চয়ই কমেছে। চায়ে চিনি-টিনি সব ঠিক আছে কি-না দেখুন।
মিসির আলি চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। চিনি ঠিক আছে। যে রকম ঘন লিকার খেয়ে তিনি অভ্যস্ত সেই ঘনত্ব ঠিক আছে। মিসির আলি দ্বিতীয় সিগারেট ধরালেন। বাথরুমে পানি ঢালার শব্দ শুনতে শুনতে তিনি সিগারেট টানছেন। তার মাথায় কিছু প্রশ্ন চলে এসেছে। তিনি চাচ্ছেন না। এই মুহুর্তে প্রশ্নগুলি আসুক। কিন্তু প্রশ্নগুলি আসছে।
১. মনসুরকে তিনি মেয়েটির নাম বলেন নি। কিন্তু সে স্পষ্ট বলেছে আমি আঁখিতারার জ্বর নামিয়ে দিচ্ছি। নামটা সে জানল কীভাবে?
২ থার্মোমিটার আনার জন্য সে ছুটে ঘর থেকে বের হলো। থার্মোমিটার নিয়ে দু’মিনিটের মাথায় ফিরে এলো। আশপাশে কোনো ফার্মেসি নেই।
অষুধ যেমন তার পকেটে ছিল। থার্মোমিটারও কি পকেটে ছিল? অনেকেই অষুধ সঙ্গে নিয়ে ঘোরে। পকেটে থার্মোমিটার নিয়ে ক’জন আর ঘুরে? তারপরেও ধরে নেওয়া যাক মনসুর অল্প কিছু অদ্ভুত মানুষের একজন, যার স্বভাব পকেটে থার্মোমিটার নিয়ে ঘোরা। তাহলেও সমস্যা আছে। কেন সে বলল, থার্মোমিটার কিনে নিয়ে আসি? সে বলতে পারত। আমার সঙ্গে থার্মোমিটার আছে।
স্যার, আরেক কাপ চা খাবেন?
মিসির আলি বললেন, না। মেয়েটার অবস্থা কী?
অবস্থা ভালো না স্যার।
ভালো না মানে?
জ্বর নামে নি। হাসপাতালে ফেলে দিয়ে আসি?
মিসির আলি কঠিন গলায় বললেন, হাসপাতালে ফেলে দিয়ে আসি মানে! এটা কেমন কথা?
কথার কথা বলেছি। স্যার। শিশু হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেই। আমার জানাশোনা আছে অসুবিধা হবে না। একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে আসি। আপনি কি সঙ্গে যাবেন?
অবশ্যই আমি সঙ্গে যাব।
আপনি রেস্ট নিন, আমি ভর্তি করিয়ে আপনাকে খবর দিয়ে যাব। কোনো সমস্যা নেই।
আমার রেস্টের চেয়ে মেয়েটির চিকিৎসা অনেক বেশি প্রয়োজন। তুমি সময় নষ্ট না করে ট্যাক্সি, বেবিট্যাক্সি কী আনবে আনো।
মনসুর সিগারেট ধরাল। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট স্বরে বলল, মেয়েটা বাঁচবে না।
মিসির আলি হতভম্ভ হয়ে বললেন, তুমি কী বলতে চাচ্ছ?
মনসুর আবেগশূন্য গলায় বলল, মেয়েটা বাঁচবে না।
তুমি কী করে বুঝলে?
স্যার, আমি ডাক্তার না। কিন্তু আমার কিছু ক্ষমতা আছে। আমি কিছু কিছু জিনিস আগে আগে বুঝতে পারি। আমি মৃত্যুর গন্ধ পাই। আপনাকে তো স্যার আগেও বলেছি আমার কিছু বিশেষ ক্ষমতা আছে। মৃত্যুর গন্ধ কেমন আপনাকে একটু ব্যাখ্যা করি।