মিসির আলি সাহেব!
কি।
আমি বুদ্ধি খাটিয়ে এ রকম দু’একটা কথা বলি। লোকে মনে করে আমার বিরাট আধ্যাত্মিক ক্ষমতা। কেউ চিন্তাও করে না। আমার ক্ষমতাটা আধ্যাত্মিক নাও হতে পারে। আমি যতদূর শুনেছি আপনি একজন মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে পারেন। আপনি যখন বলেন তখন কিন্তু আপনার ক্ষমতাকে কেউ আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ভাবে না।
মিসির আলি বললেন, আমি যদি আপনার মতো লম্বা দাড়ি রাখি, চোখে সুরমা দেই, মাথায় পাগড়ি পরি তখন আমার ক্ষমতাকেও লোকে ভাববে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা।
হুজুরে কেবলা বললেন, আমি মাঝে মাঝে ভবিষ্যদ্বাণী করি। আমাকে করতে হয়। আমি যাকে যা বলি তাই নাকি সত্যি হয়। এই বিষয়ে আপনার মতামত কি।
মিসির আলি বললেন, আপনি হয়তো নস্ট্রাডেমাস স্টাইলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন।
সেটা কি?
নস্ট্রাডেমাসের জন্ম ফরাসিতে ১৫০৩ সনে। তিনি অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তার ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে সারা পৃথিবীতে খুব হৈচৈ হচ্ছে। কারণ সবাই বলছে তিনি যা বলেছেন সব মিলে যাচ্ছে। আসলে কিন্তু তা না। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন কবিতার আকারে। সরাসরি কখনো কিছু বলেননি। এই কারণে মনে হয় যা বলা হচ্ছে সবই মিলে যাচ্ছে।
ভদ্রলোকের নাম কি বললেন?
নস্ট্রাডেমাস।
উনি অস্পষ্টভাবে কবিতায় ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন?
জি।
উদাহরণ দিতে পারবেন?
উনি বলেছেন
An emperor will be born near Italy.
Who will cost the empire very dearly.
খুবই অস্পষ্ট কথা। এই emperor নেপোলিয়ান হতে পারেন, আবার হিটলারও হতে পারেন। আবার অস্ট্রিয়ার রাজাও হতে পারেন।
আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি বুঝেছি। তবে আমি কিন্তু অস্পষ্টভাবে কিছু বলি না। আমি যা বলি স্পষ্টভাবে বলি। আপনার সম্পর্কে একটা ভবিষ্যদ্বাণী করব?
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, করুন।
পীর ভাই নির্বিকার ভঙ্গিতে অত্যন্ত স্পষ্ট স্বরে বললেন–আপনি দু’একদিনের মধ্যে বিরাট বিপদে পড়তে যাচ্ছেন। এমন বিপদ যার কোনো পারাপার নাই।
কি ধরনের বিপদ?
জীবন সংশয় হয় এমন বিপদ। এর বেশি কিছু বলব না।
পীর ভাই উঠে দাঁড়ালেন। মিসির আলি তাকিয়ে আছেন। পীর ভাই-এর মুখে হাসি। হাসির মধ্যে শিশুর ভঙ্গিমা আছে। শিশুরা কোনো একটা চালাকি করে বড়দের হারিয়ে দিলে এ রকম করে হাসে।
রাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন লম্বা এক মানুষ তাঁর ঘরে ঢুকেছে। মানুষটা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আতরের গন্ধে ঘর ভর্তি হয়ে গেল। স্বপ্নের মধ্যেই মিসির আলি অস্বস্তি বোধ করছেন। স্বপ্ন হবে বর্ণ এবং গন্ধহীন, তাহলে তিনি গন্ধ পাচ্ছেন কেন? লম্বা মানুষটা তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আসসালামুআলাইকুম। তার গলা অপূর্ব সুরেলা। স্বপ্নের মধ্যেই মিসির আলি উঠে বসলেন। লম্বা মানুষটা বললেন, আমার ভবিষ্যদ্বাণী কি মিলেছে মিসির আলি সাহেব?
মিসির আলি বললেন, ও আচ্ছ। আপনি।
লম্বা মানুষটা বললেন, কথার জবাব দিন, আমার ভবিষ্যদ্বাণী কি মিলেছে?
মিসির আলি বললেন, না। আমি কোনো বিপদে পড়িনি। আঁখিতারা বিপদে পড়েছে।
আপনি বিপদে পড়েছেন। আপনি বুঝতে পারছেন না।
মিসির আলি বললেন, আপনার কথা আমি সত্যি বলে ধরে নিলাম। ধরে নিলাম আমিই বিপদে পড়েছি। এখন বলুন আপনি কি করে বুঝলেন আমি বিপদে পড়ব।
সেটা বলব না।
কেন বলবেন না?
সব কিছু সবাইকে বলতে নেই। সব রহস্য সবাইকে জানতে নেই।
মিসির আলি বললেন, রহস্য আগলে রাখা ঠিক না। বিজ্ঞানীরা যখনই কোনো রহস্য ধরে ফেলেন তখনই তাঁরা তা সবাইকে জানান। পৃথিবী যে আজ এত দূর এগিয়েছে এই কারণেই এগিয়েছে। তারা রহস্য আগলে বসে থাকলে আমরা এত দূর আসতে পারতাম না। অন্ধকারে ড়ুবে থাকতাম।
অন্ধকারে ড়ুবে থাকাই ভালো।
তাই কি?
হ্যাঁ ভাই। আপনি ঘুমুচ্ছেন। ঘুম হলো অন্ধকার। অন্ধকার ভালো না?
মিসির আলি জবাব দিলেন না। গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেলেন।
আঁখিতারার জ্বর এসেছে
আঁখিতারার জ্বর এসেছে।
সে চাদর গায়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। চাদরে শীত মানছে না। একটু পরপর কোপে কেঁপে উঠছে। মিসির আলি তার কপালে হাত রেখে চমকে উঠেছেন। জুরে গা পুড়ে যায় বলে যে বাক্যটি প্রচলিত সেটা পুরোপুরি সত্যি বলে
মনে হচ্ছে।
আঁখিতারা, শরীর বেশি খারাপ লাগছে?
সে চোখ মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। মিসির আলি অস্থির বোধ করলেন। অসুখ-বিসুখের ব্যাপারগুলিতে তিনি অস্থির বোধ করেন। অসহায়ও বোধ করেন। অসুখ-বিসুখের সমস্যা মোকাবিলার মতো শক্তি তার নেই।
পানি খাবে? পানি?
আঁখিতারা আবারও চোখ মেলল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
মেয়েটির জ্বর কমানোর ব্যবস্থা করা দরকার। ডাক্তার ডাকা দরকার। মেয়েটি যেভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার অবশ্যই শীত লাগছে। তিনি কি এখন তার গায়ে লেপ দিয়ে দেবেন? এতে মেয়েটার শীত ভাব কমবে। অথচ তিনি জানেন জ্বর কমানো কী করে সম্ভব।
আঁখিতারা, শরীর বেশি খারাপ লাগছে?
না।
অনেকক্ষণ পর সে প্রথম একটা শব্দ করল। এক অক্ষরের এই শব্দ করতেও মনে হয় তার খুব কষ্ট হলো।
মিসির আলি বললেন, শীত লাগছে?
হুঁ।
গায়ে লেপ দিয়ে দেব?
হুঁ।
মিসির আলি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। লেপ দিয়ে কি মেয়েটাকে ঢেকে দেবেন? শরীর তার প্রয়োজনের কথা জানাচ্ছে। এই প্রয়োজন কি মিটানো উচিত নয়? আমাদের যখন ক্ষিদে পায় শরীর সেটা জানান দেয়। তখন খাদ্য গ্ৰহণ করতে হয়। আঁখিতারার শরীর জানাচ্ছে তার শীত লাগছে। কাজেই তার শীত কমানোর ব্যবস্থা করাই তো যুক্তিযুক্ত। যদিও ডাক্তাররা বলেন–এই অবস্থায় গায়ে পানি ঢালতে হবে। প্রয়োজনে বরফ-মেশানো পানিতে বাথটাবে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে রাখতে হবে। ব্যাপারটা এমনও হতে পারে–জ্বরতপ্ত মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। নিউরোন এলোমেলো সিগন্যাল দেয়।