আজমল সাহেব উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই মনসুরের আসল নাম কি মিসির আলি ধরে ফেললেন। আজমল সাহেবের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে মনসুরের আসল নামের কোনো সম্পর্ক নেই। তবু নামের ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়ার ঘটনা। এই সময়ই ঘটল।
মনসুরের আসল নাম চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়া। সোনার বাংলা পত্রিকার সম্পাদক। চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়ার লেখা–সম্পাদকীয়, গল্প এবং রম্যরচনা তিনটিতেই বিশেষ একটা শব্দ দিয়ে বাক্য শুরুর প্রবণতা আছে। শব্দটা হলো ‘হয়তোবা’। মনসুর তাকে যে চিঠি লিখেছে সেই চিঠিতেও দুটি বাক্য শুরু হয়েছে হয়তোবা দিয়ে।
সোনার বাংলা পত্রিকার প্ৰিন্টার্স লাইনে পত্রিকার ডিক্লারেশন নাম্বার, রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার সবই দেওয়া। বাংলাদেশ সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্ম অ্যান্ড পাবলিকেশন-এ টেলিফোন করলে চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়ার সব খবর বের হয়ে আসবে। ছোট্ট একটা জটি খুললে অনেকগুলি জট খুলে যায়।
রান্নাঘর থেকে আঁখিতারা উকি দিচ্ছে। মিসির আলি বললেন, আঁখিতারা, চা, বানাতে পারে?
আঁখিতারা হাসি মুখে বলল, পারি।
কোথায় শিখেছি?
বাপজান খুব চা খায়।
কড়া করে এক কাপ চা বানাও। চিনি দেবে এক চামচ। সমান সমান করে এক চামচ দেবে কনডেন্সড মিল্ক।
আঁখিতারা অতিদ্রুত চা বানিয়ে নিল। কাপে একটা চুমুক দিয়েই মিসির আলি বললেন, আজ থেকে তোমার নাম চা-কন্যা। আমি এত ভালো চা আমার জীবনে খাই নি।
আতরের গন্ধ
আতরের গন্ধে বাড়ি ম মা করছে। আজমল সাহেবের পীর ভাই–হুজুরে কেবলা বিন নেশান আলি আসগর কুতুবী মিসির আলির বসার ঘরে বসে আছেন। আজমল সাহেব হুজুরে কেবলাকে এখানে বসিয়ে রেখে নাশতার জোগাড় করতে গেছেন। হুজুরে কেবল বসে আছেন মূর্তির মতো। মূর্তিও মাঝে মধ্যে বাতাসে এদিক-ওদিক দুলে–পীর ভাই-এর মধ্যে সেই দুলুনিও নেই।
মিসির আলি বললেন, কেমন আছেন?
তিনি জবাব দিলেন না। তবে মিসির আলির দিকে তাকালেন। সামান্য হাসলেন।
যিনি কথা বললে জবাব দেন না তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালানোর প্রশ্ন ওঠে না। মিসির আলি চুপচাপ বসে রইলেন। আজমল সাহেব তাঁর পীর ভাইকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন এটা ঠিক স্পষ্ট হচ্ছে না। হয়তো ধর্মের লাইনে মিসির আলিকে টানতে চান। সব মানুষই নিজের দিকে মানুষকে টানতে চায়। এক চোর অন্য একজনকে চোর বানাতে চেষ্টা করে। সাধু চেষ্টা করে সাধু বানাতে।
মিসির আলির সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। তার পাঞ্জাবির পকেটে সিগারেটও আছে। দেয়াশলাইও আছে। সিগারেট ধরালে এই পীর সাহেব কি মনে করেন তা বুঝতে পারছেন না বলেই সিগারেট ধরাচ্ছেন না।
হুজুরে কেবল এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। এখন চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন। তাঁর মাথাও খানিকটা ঝুকে এসেছে। থুতনি বুকের সঙ্গে লেগে যাচ্ছে। ভদ্রলোক কি ঘুমিয়ে পড়েছেন? পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়লে সিগারেট একটা ধরানো যেতে পারে। ভদ্রলোকের চোখের পাতা দেখতে পারলে মিসির আলি সহজেই ধরতে পারতেন। ভদ্রলোক ঘুমিয়েছেন কি-না। চোখের পাতা দেখা যাচ্ছে না।
মিসির আলিকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক হঠাৎ মাথা তুললেন। চোখ মেললেন। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট স্বরে বললেন–আপনি আমাকে প্রশ্ন করেছেন–কেমন আছেন? আমি সেই প্রশ্নের জবাব দেই নাই। কারণ তখন ওজিফা পাঠ করছিলাম। জবাব না দেওয়ায় আপনি হয়তো ভেবেছেন আমি বেয়াদবি করেছি। ইচ্ছাকৃত বেয়াদবি করি নি। আপনার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অনিচ্ছাকৃত বেয়াদবি করেছি–তার জন্যে ক্ষমা চাই।
মিসির আলি বললেন, ক্ষমা করলাম।
শুকরিয়া।
মিসির আলি বললেন, ক্ষমা করলাম ঠিকই, আপনি কিন্তু এখনো প্রশ্নের জবাব দেন নি। এখনো বলেন নি কেমন আছেন।
হুজুরে কেবলা শব্দ করে হাসলেন। হাসি থামিয়ে বললেন, জনাব আমি ভালো আছি। আপনি ইচ্ছা করলে আমার সামনে সিগারেট খেতে পারেন। আমি এমন কোনো ব্যক্তি না যে আমার সামনে সিগারেট খাওয়া যাবে না। যদিও এই অভ্যাস স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
মিসির আলি সামান্য চমকালেন। হুজুরে কেবলা এমন ভঙ্গিতে কথা বলেছেন যাতে মনে হতে পারে তিনি থট রিডিং জানেন। মিসির আলি মনে মনে ঠিক যা ভাবছেন তা বলতে পারছেন।
সিগারেট ধরাবার ইচ্ছা মিসির আলির হচ্ছে এটা ঠিক। হুজুরে কেবলার জন্যে সিগারেট ধরাতে সংকোচ হচ্ছে এটাও ঠিক। কিন্তু ব্যাপারটা হুজুরে কেবলার জানার কথা না।
মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। হুজুরে কেবল বললেন, আপনাকে সিগারেট ধরাতে বলেছি। এতে আপনি সামান্য চমকেছেন বলে আমার মনে হলো। চমকানোর কিছু নেই। আপনার এশট্রেতে সিগারেট দেখে বুঝেছি আপনি সিগারেট খান। আপনার গা থেকেও সিগারেটের গন্ধ আসছিল। যারা সিগারেট খায় তারা যখন অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়ে তখন তাদের সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা! করে। আমার সামনে আপনি বসে আছেন, আপনি আমাকে প্রশ্ন করছেন, আমি জবাব দিচ্ছি না। আপনি পড়েছেন অস্বস্তিকর পরিবেশে। কাজেই আমি ধরে নিয়েছি আপনার সিগারেট ধরাবার ইচ্ছা হচ্ছে।
মিসির আলি এতক্ষণ ভদ্রলোকের দিকে ভালোভাবে তাকান নি। এবার তাকালেন। বয়স অল্প। পাঁচিশ-ছাব্বিশ। টকটকে গৌরবর্ণ। টানাটানা চোখ সুরমা দিয়ে সেই চোখ আরো টানা হয়েছে। ঠোঁট টকটকে গোলাপি। পুরুষদের যে কোনো সৌন্দৰ্য প্রতিযোগিতায় তিনি অবশ্যই ফাস্ট প্রাইজ কিংবা রানার্সআপ প্ৰাইজ নিয়ে নেবেন।