- বইয়ের নামঃ হরতন ইশকাপন
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিরিজ বইঃ মিসির আলী
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
স্যার ম্যাজিক দেখবেন
স্যার ম্যাজিক দেখবেন?
মিসির আলি বিরক্ত মুখে প্রশ্ন কতাঁর দিকে তাকালেন। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক। বোঝা যাচ্ছে অভাব-অনটনে আছে। গায়ের শার্ট মলিন। চেহারাও শার্টের মতোই মলিন। যদিও হাসি-খুশি ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টায় লাভ হচ্ছে না। যুবকের চোখেও মনে হয় সামান্য সমস্যা আছে। সারাক্ষণ চোখ পিটপিট করছে। চোখের অশ্রুগ্রন্থি ঠিকমতো কাজ না করলে চোখ পিটপিট রোগ হয়। এর কি তাই হয়েছে? সে ক্ষুধার্তও। তাকে পিরিচে করে বিস্কিট এবং চানাচুর দেয়া হয়েছিল। সে সবই খেয়েছে। বিস্কিটের কিছু কণা পড়ে ছিল। তৰ্জনীর মাথায় সেই কণাগুলো মাখিয়ে সে জিভে ছোঁয়াল।
যুবকের নাম তিনি জানেন না। নাম জানার কোনো আগ্রহও বোধ করছেন না। তাঁর কাছে যুবকটি কেন এসেছে তা-ও ধরতে পারছেন না। তিনি এমন কোনো মজার চরিত্র না যে তাঁর সঙ্গে কথা বলে কেউ মজা পাবে। যুবক আবার বলল, স্যার, ম্যাজিক দেখবেন?
মিসির আলি বললেন, ম্যাজিক দেখব না। ম্যাজিক আমার পছন্দের বিষয় নয়।
যুবক হাসি হাসি গলায় বলল, কেন পছন্দ না জানতে পারি?
মিসির আলি বললেন, ম্যাজিকের ভেতর প্রতারণার একটা ব্যাপার থাকে। এই প্রতারণার অংশটা আমার অপছন্দ। আমি প্রতারণা পছন্দ করি না।
স্যার আমি যে ম্যাজিক দেখাব তার মধ্যে কোনো প্রতারণা নেই। মেন্টাল ম্যাজিক। আমার অনেক দিনের শখ আমি আমার মানসিক ক্ষমতার নমুনা আপনাকে দেখাই।
যুবকের মানসিক ক্ষমতা দেখার ব্যাপারেও মিসির আলি কোনো আগ্ৰহ বোধ করলেন না। তিনি নিজের উপর সামান্য বিরক্তও হলেন। তাঁর কৌতুহল এত দ্রুত কমছে কেন? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কৌতুহল কমতে থাকে? সেই কমার হারটা কেমন?
মিসির আলি বললেন, তোমার নাম কী?
যুবক আগ্রহের সঙ্গে বলল, মনসুর। আপনার সঙ্গে আমার কিছু মিল আছে। আপনার নামের শুরু ম দিয়ে। আমার নামের শুরুও ম দিয়ে।
যুবক আবারো বলল, আমি কি স্যার আমার মানসিক ক্ষমতার একটা ম্যাজিক আপনাকে দেখাব? দেখলে আপনি খুবই মজা পাবেন।
মিসির আলি হ্যাঁ বা না বলার আগেই মনসুর পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। হতদরিদ্র যুবকদের পকেটেও কেন জানি দামি সিগারেটের প্যাকেট থাকে। এর কাছে তা নেই। সমস্ত সিগারেটের প্যাকেটের ন্যাতন্যাতা ফিল্টারবিনীহ সিগারেট।
আমি ম্যাঞ্জিকটা দেখাব সিগারেট দিয়ে।
মনসুর একটা সিগারেট টেবিলের উপর রাখল। মেরুদণ্ড সোজা করে বসল। সিগারেটের দিকে এখন সে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে। তার মাথা নিচু হয়ে আছে। চোখে পিটপিটানিও বন্ধ।
স্যার ভালো করে দেখুন। আমি সিগারেটটা হাত দিয়ে স্পর্শও করি নি। আমি শুধু তাকিয়ে আছি। দেখুন চোখের দৃষ্টিতে আমি কী করছি!
মিসির আলি মোটামুটি বিস্মিত হলেন। সিগারেট নড়ছে। গড়িয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে। বিস্মিত হবার মতোই ব্যাপার।
যুবকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে মানসিক ক্ষমতার এই ম্যাজিক দেখাতে তার রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে।
স্যার কেমন দেখলেন?
ভালো। ইমপ্রেসিভ।
এখন যা দেখলাম তার নাম টেলি-কাইনেটিক্স। মানসিক শক্তির সাহায্যে বস্তুকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরানো! আপনি কি টেলি-কাইনেটিক্সের কথা শুনেছেন?
শুনেছি।
মনসুর লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, ইসরায়েলের এক যুবক, তার নাম যুরি গেলার। সে মানসিক ক্ষমতা দিয়ে চামচ বাঁকা করে ফেলতে পারত। আমার এত ক্ষমতা নেই। তবে যা আছে তা-ও খারাপ না। চামচ বাঁকা করতে না পারলেও আমি পাতলা তার বাঁকা করতে পারি। ঠিক বলেছি না। স্যার?
মিসির আলি সামান্য নড়ে বসলেন। হ্যাঁ-না কিছু বললেন না। টেবিলের উপর থেকে সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে দিল। দিয়াশলাই দিয়ে সিগারেট ধরাল। সিগারেট একবারে ধরল না। বেশ কয়েকটা কাঠি খরচ করতে হল। একজন বয়স্ক মানুষ সামনে বসে আছে তা নিয়ে তার মধ্যে কোনো সঙ্কোচ দেখা গেল না।
সিগারেট থেকে তীব্ৰ গন্ধ আসছে। গাঁজার গন্ধ। মিসির আলির মন সামান্য খারাপ হল।
সিগারেট শেষ করে আমি আমার ক্ষমতার অন্য একটা ভার্সান আপনাকে দেখাব। আপনি মজা পাবেন।
আচ্ছা।
আপনার সামনে সিগারেট টানছি আপনি কিছু মনে করছেন না তো? সস্তা সিগারেট বলেই এমন কড়া গন্ধ আসছে। আপনি যা ভাবছেন তা কিন্তু না। গাঁজা না।
মনে করছি না।
এখন স্যার মোটা দেখে একটা বই আমার হাতে দিন। যতটা মোটা হয় তত ভালো।
ডিকশনারি দিলে চলবে?
চলবে।
মনসুরের সিগারেট শেষ হয় নি। সে আধা খাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে বই নিয়ে বসল। তার ধানমগ্ন মূর্তি দেখতে ভালো লাগছে। মিসির আলি বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন। মনসুর তার দুই হাত দিয়ে কোমর ধরে আছে। একটু ঝুঁকে এসেছে বইয়ের দিকে। তার কপাল আবারো ঘামছে! ঘটনা যা ঘটছে তা বিস্ময়কর। বইয়ের পাতা একের পর এক উল্টে যাচ্ছে।
স্যার কেমন দেখছেন?
ভালো। আমি হিপনেটিজমও পারি। যে কোনো মানুষের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি।
ও আচ্ছা।
আজ অবশ্য পারব না। আজ আমার মন ভালো নেই। কোনো কিছুতেই কনসেনট্রেট করতে পারছি না। মন অসম্ভব খারাপ। এই মুহুর্তে আমার চেয়ে বেশি মন খারাপ মানুষ বাংলাদেশে আছে বলে মনে হয় না।