চিনি।
আরেকবার পাঠিয়েছিলাম এক শ একটা ডাব। ডাব পাঠানোর পর উনার সঙ্গে আমার বন্ধুর মতো সম্পর্ক হয়ে গেছে। মাই ডিয়ার লোক। আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিব। পুলিশের সঙ্গে পরিচয় থাকা ভালো। কখন কোন কাজে লাগে। চা খাব, আপনার কাজের ছেলেটাকে সুন্দর করে এক কাপ চা বানাতে বলেন। বাসায় ঝামেলা, চা বানানোর অবস্থায় কেউ নাই বিধায় আপনার এখানে চা খেতে এসেছি।
মিসির আলি বললেন, কী ঝামেলা?
ছক্কার ছেলেটা মারা গেছে। নিউমোনিয়া হয়েছিল। ডাক্তাররা বুঝে না-বুঝে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক বিষ ছাড়া কিছু না।
মল্লিক। সিগারেট ধরালেন। মিসির আলি বললেন, আপনার নাতি মারা গেছে, আর আপনি স্বাভাবিকভাবে গল্পগুজব করছেন?
মল্লিক বললেন, মৃত্যু হলো কপালের লিখন। দুঃখ করে লাভ কী? যত স্বাভাবিক থাকা যায় ততই ভালো।
মিসির আলি বললেন, ছক্কা কি তার ছেলের মৃত্যুসংবাদ জানে?
মল্লিক বললেন, না। পুলিশের ডলা খেয়ে বাড়ি ফিরে জানবে। ডাবল অ্যাকশান হবে।
জসু চা বানিয়ে এনেছে। মল্লিক তৃপ্তি করেই চা খাচ্ছেন। মিসির আলি তাকিয়ে আছেন মানুষটার দিকে।
মল্লিক সাহেব চায়ের কাপ নামিয়ে মিসির আলির দিকে খানিকটা ঝুকে এসে বললেন, আপনাকে বলেছি না। আপনার বাসায় একজন মৃত মানুষকে ঘোরাফিরা করতে দেখি?
জি বলেছেন।
এই মানুষটার পরিচয় জেনেছি। উনি আপনার পিতা।
ও আচ্ছা।
মল্লিক সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, “ও আচ্ছা” বলে উড়ায়ে দিবেন না। উনি আমাকে বলেছেন, আপনি মহাবিপদে পড়বেন। গাড়ি চাপা পড়ে মারা পড়বেন। গাড়ির রঙ কালো। গাড়ি চালাবে অল্পবয়সী মেয়ে। বুঝেছেন?
জি।
সাবধানে থাকবেন। সাবধানে। সাবধানের কোনো মাইর’ নাই। কথায় আছে–
বামে না ডানে
চল সাবধানে।
আপনার পিতা আমাকে বলেছেন আপনাকে সাবধান করে দিতে। সাবধান করে দিলাম।
মিসির আলি খাতা খুলে বসেছেন
মিসির আলি খাতা খুলে বসেছেন। আজকের দিন শুরু করবেন ব্যক্তিগত কথামালায় এক পাতা লিখে। তাঁর সামনে চায়ের কাপ, পিরিচে টোষ্ট বিস্কুট।। সকালের প্রথম চা। জসু পরোটা-ভাজি আনতে গেছে। সে নিজে ভালো পরোটা বানায়, তবে নিজের বানানো পরোটা সে খেতে পারে না। তার পরোটা-ভাজি সে দোকান থেকে কিনে আনে। দুপুরে প্রায়ই সে মল্লিক সাহেবের কাঁচ্চি হাউস থেকে খেয়ে আসে। কাঁচ্চি হাউসের লোকজন তাকে চেনে। জসুকে টাকা দিতে হয় না।
মিসির আলি লিখছেন–
নাতিদের প্রসঙ্গে মল্লিক সাহেব দু’বার আমাকে বলেছেন, তার এক হালি নাতি। দুই নাতি এবং দুই নাতনি।
আমি তাঁর দুই নাতির কথাই জানি। জসুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেও দুই জনের কথাই বলছে।
মল্লিক সাহেবের দুই ছেলে যেমন তাদের দুই বাবাকে দেখে, মল্লিক সাহেবও কি একইভাবে দুই নাতির জায়গায় চার নাতি দেখেন? বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। তবে তাড়াহুড়ার কিছু নেই। হাতে সময় আছে।
মল্লিক সাহেবের বাড়ির অবস্থা শান্ত। “পশ্চিম রণাঙ্গন নিচুপ’-টাইপ শান্ত। একটি শিশু মারা গেছে, তার প্রভাব কারও ওপরেই মনে হয় পড়ে নি। ছক্কা-বক্কা ছেলে কোলে নিয়ে আগের মতোই হাঁটাহাঁটি করছে। আগে দু’জনের কোলে দুটি ছেলে থাকত। এখন একজন ভাগাভাগি করে দু’জনের কোলে থাকছে।
সুরমা হোমিও হাসপাতালে মল্লিক সাহেব নিয়মিত বসা শুরু করেছেন। সুরমা তাঁর প্রথম স্ত্রীর নাম।
এই স্ত্রীকে মনে হয় মল্লিক সাহেব খুবই পছন্দ করতেন। তাঁর বেবিটেক্সির প্রতিটির পেছনে লেখা, ‘সুরমা পরিবহন’।
মল্লিক সাহেবের প্রথম স্ত্রী সম্পর্কে কোনো তথ্য এখনো আমার হাতে নেই। মহিলা রূপবতী ছিলেন, সবসময় বোরকা পরে থাকতেন। ঘরের মধ্যেও বোরকা খুলতেন না।
এই বাড়ির সবকিছুই জট পাকিয়ে আন্ধা গিন্টু হয়ে আছে। এই জাতীয় আন্ধা গিন্টুর সুবিধা হচ্ছে, কোনোরকমে একটা গিন্টু খুলে ফেললে বাকিগুলি একের পর এক আপনাতেই খুলতে থাকে। আমাকে অবশ্যি গিন্টু খোলার দায়িত্ব কেউ দেয় নি। কর্মহীন মানুষ কর্ম খুঁজে বেড়ায়। আমার মনে হয় এই দশাই চলছে।
মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন। ঠান্ডা সরপড়া চায়ে চুমুক দিলেন। তাঁর মুখ সামান্য বিকৃতও হলো না। নিজের মনেই ভাবলেন, এক ধরনের নির্বিকারত্ব সবার মধ্যেই আছে। তিনি যেমন চায়ের ঠান্ডা গরম বিষয়ে নির্বিকার, মল্লিকের দুই পুত্ৰও আশপাশে কী ঘটছে। সেই বিষয়ে নির্বিকার। পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গেলেও তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের শিশুপুত্ৰ বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেও তাদের কিছু যায় আসে না। অবশ্য এই শিশুটা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে তা না। মল্লিক সাহেব তার চিকিৎসা করেছেন। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দিয়েছেন। অ্যান্টিবায়োটিক খেতে দেন নি। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক শিশুদের জন্য বিষ।
সিগারেট হাতে বারান্দায় এসে মিসির আলি অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলেন। মল্লিক সাহেবের দুই ছেলে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কানে ধরে উঠবোস করছে। কতবার উঠবোস। করা হচ্ছে তারা সেই হিসােবও রাখছে। শব্দ করে বলছে—৪১, ৪২, ৪৩
ছক্কা-বক্কা দুই ভাইয়ের একটির শিশুপুত্র দু’জনের মাঝখানে শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। তার হাতে কাঠি লজেন্স। সে লজেন্স চুষছে।
এ ধরনের দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না। মিসির আলি ঘরে ঢুকে The Others Side of Black Hole বই খুললেন। বিজ্ঞান যে পর্যায়ে চলে গেছে এখন যে-কোনো গাঁজাখুরি গল্পও বিজ্ঞান বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। ব্ল্যাকহোলের বইটিতেও লেখক এই জিনিস করেছেন। কঠিন বিজ্ঞানের লেবাসে কল্পগল্প।