মল্লিক বললেন, যখন বড়টার বয়স পাঁচ আর ছোটটার তিন।
তারা করত কী?
আমার সামনে যখন দাঁড়িয়ে থাকত তখন আমার দিকে তাকাত না। দুইজনেই আমার দুই ফুট দূরে, আমার ডানদিকে তাকায়ে থাকত। আমি কোনো প্রশ্ন করলে সেই দিকে তাকিয়েই উত্তর দিত।
এই কাজ কেন করত। জিজ্ঞেস করেন নাই?
করেছি। একবার না, অনেকবার করেছি।
তাদের জবাব কী?
তারা নাকি দুইজন বাবা দেখে। একটা বাবা খারাপ, একটা ভালো। তারা তাকিয়ে থাকে ভালো বাবার দিকে।
আপনি তাহলে তাদের কাছে খারাপ বাবা?
হুঁ। যতবার দুই ভাই এই রকম কথা বলেছে ততবার এদের শক্ত মাইর দিয়েছি। একবার তো বড়টার গলা চিপে ধরলাম। গো গো শব্দ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। আমি ভাবলাম, মরে গেছে। কিছুক্ষণ পর উঠে বসে চি চি করে বলে, বাবা, পানি খাব।
আপনার দিকে তাকিয়ে কি বলেছে?
না, ওই যে বললাম, দুই ফুট দূরে তাকায়। আমার ডানে।
এরা দু’জন দেখি সবসময় একই রকম কাপড় পরে। এটা কখন থেকে শুরু হলো?
মল্লিক সাহেব হতাশ গলায় বললেন, তারা দু’জন যে শুধু একই রকম কাপড় পরে তা না, তাদের বউ দুইটারও একই চেহারা। যমজ বোন। একটার নাম পারুল, আরেকটার নাম চম্পা। বুঝার উপায় নাই, কোনটা কে। আমি কোনোদিনই বুঝি না। আমার ধারণা, আমার দুই বদ পোলাও জানে না কোনটা কে?
পুত্রবধূদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
খারাপ।
কতটা খারাপ?
পারুলকে আমি ডাকি বড় কুত্তি, চম্পাকে ডাকি ছোট কুত্তি। এখন বুঝে নেন সম্পর্ক কত খারাপ। এদের স্বভাব চরিত্রও কুত্তির মতো। কেন তা বলব না। শ্বশুর হয়ে পুত্রবধূদের বিষয়ে নোংরা কথা বলা যায় না।
মল্লিক উঠে দাঁড়ালেন, মিসির আলিকে কোনো কিছু না বলেই হঠাৎ করে বের হয়ে গেলেন। ঘুমুতে যাওয়ার আগে মিসির আলি ব্যক্তিগত কথামালার খাতা খুলে কিছুক্ষণ লিখলেন–
ছক্কা-বক্কা এবং তাদের বাবার ব্যাপারে আমি কিঞ্চিৎ আগ্ৰহ বোধ করছি। তাদের পুরো কর্মকাণ্ডে এক ধরনের অসুস্থতা আছে। ছেলে দুটি মানসিক রোগগ্ৰস্ত, নাকি তাদের বাবা? বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কার না। মন্ত্রিক সাহেবের কথাবার্তা শুনে মনে হয় তাঁর পুত্রবধূদেরও কিছু সমস্যা আছে।
দুটি ছেলেই বাবাকে অসম্ভব ভয় পায়। সেটাই স্বাভাবিক। যে বাবা শাস্তি হিসেবে গলা চেপে ধরে অজ্ঞান করে ফেলেন, তাকে ভয় না পেয়ে উপায় নেই।
এমন কি হতে পারে, বাবাকে অসম্ভব ভয় পায় বলেই এরা অন্য এক বাবাকে কল্পনা করেছে, যে বাবা ভালো, স্নেহময়? কল্পনার সেই বাবা, খারাপ বাবার ডানদিকে দুই ফুট দূরত্বে থাকেন। মস্তিষ্ক চাপ সহ্য করতে পারে না। চাপ মুক্তির পথ খোজে। একটি ভালো বাবা কল্পনা করে নেওয়া চাপমুক্তির পথ।
দুটি ছেলেই অন্তর্মুখী। এদের পক্ষে দুই যমজ বোনের প্রেমে পড়ে নিজেদের ইচ্ছেয় বিয়ে করা অসম্ভব। আমি নিশ্চিত, মল্লিক সাহেব দুই ছেলের বিয়ের জন্যে জমজ বোন খুঁজে বের করেছেন। তাঁর আগ্রহেই বিয়ে হয়েছে।
দুই ভাই একই পোশাক পরে। বিষয়টা তারা করেছে, না তাদের বাবা ঠিক করে দিয়েছে?
একই চেহারার দুই স্ত্রী যিনি ঠিক করে দিয়েছেন, তিনিই একই পোশাকের ব্যাপারটা করবেন। সাধারণ লজিক তা-ই বলে।
আরও রহস্য আছে। ছক্কা-বক্কা দু’জনেরই একটি করে ছেলে (যদিও মল্লিক বলেন তাদের চারটি সন্তান)। তাদের বয়স কাছাকাছি। দুই থেকে তিন বছর। বেশির ভাগ সময় তারা বাবার কোলে থাকে। দুই বাবাই সন্তান কোলে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লান্তিহীন হাঁটাহাঁটি করেন। ছক্কার ছেলেই যে ছক্কার কোলে থাকে তা না, কখনো সে থাকে বক্কার কোলে। কে কার কোলে থাকবে তা নিয়ে ধরাবাধা কোনো ব্যাপার নেই। রহস্য হচ্ছে যখন যে শিশু যার কোলে থাকবে তাকেই বাবা ডাকবে।
মল্লিক সাহেব দাবি করেন, তিনি মৃত মানুষদের দেখতে পান। তাদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেন। একটি পরিবারের সবাই ডিলিউশনে ভুগবেন, এটাই বা কেমন কথা! কোনো পরিবারে একজন কঠিন মানসিক রোগী থাকলে তার প্রভাব অন্যদের ওপর পড়বে। এটা স্বাভাবিক। তবে সুস্থ মানুষ কখনোই অসুস্থ হয়ে পড়বে না।
দুৰ্বোধ্য রহস্যের মুখোমুখি হলে বেশিরভাগ মানুষ এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিয়ে শেক্সপিয়ার আওড়ায়। দার্শনিক ভােব ধরে বলে–There are many things in heaven and earth…
মিসির আলি হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ না। তিনি রহস্যের ভেতর ঢুকতে চাইছেন। দুই ভাইয়ের কাছ থেকে কয়েকটা জিনিস জানা তার খুবই প্রয়োজন। দুই ভাইকে তিনি পাচ্ছেন না। তারা সারা দিন নানান জায়গায় ঘোরে, গভীর রাতে বাবার কাঁচ্চি হাউসে ঘুমিয়ে থাকে।
মিসির আলি কয়েকবার তাদের খোজে জালুকে পাঠিয়েছেন। জসু তাদের পায় নি।
দুই ভাই বিষয়ে মল্লিক এক রাতে তথ্য দিলেন। মিসির আলিকে আনন্দের সঙ্গে জানালেন, ওরা হাজতে।
মিসির আলি বললেন, হাজতে কেন? কী করেছে?
নতুন কিছু করে নাই। পুরানো পাপে হাজত বাস করছে। রমনা থানার ওসি সাহেবকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলেছি, দুজনকে ধরে নিয়ে যেন ভালোমতো ডলা দেওয়া হয়। তিন দিন হাজত বাস করে ফিরবে। শিক্ষা সফরের ব্যবস্থা। এ রকম শিক্ষা সফর আগেও একবার করেছে।
আপনি ব্যবস্থা করেছেন?
হ্যাঁ, ওসি সাহেবের সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে। প্রায়ই ওনাকে অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস উপহার হিসাবে পাঠাই। একবার পাঠিয়েছিলাম এক কলসি রাবরি। রাবরি চেনেন?