ছাপা হ্যান্ডবিল নিয়ে দুই ভাই মিসির আলির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সেই আগের মতো অবস্থা। দু’জনের গায়েই এক রকম কাপড়। প্রথম দিনের মতোই দু’জন পা নাচাচ্ছে। সেই পা নাচানো অসম্ভব ‘সিনক্রানাইজড’। যেন একে অন্যের সঙ্গে অদৃশ্যভাবে যুক্ত। বড়জনের ডান পা। যখন নাচছে, তখন ছোটজনের ডান পা-ই নাচছে। সামান্য এদিক-ওদিকও হচ্ছে না।
ছক্কা বলল, চাচাজি ভালো আছেন?
মিসির আলি বললেন, ভালো আছি।
বক্কা বলল, বাবার কুলখানির তারিখ ফেলেছি। আগামী বিষু্যদবার বাদ মাগরেব। মিলাদ হবে, দোয়া হবে, এশার নামাজের পর বড়খানা।
ছক্কা বলল, বড়খানায় থাকবে মুরগির রোস্ট, কাঁচ্চি বিরিয়ানি আর বোরহানি।
মিসির আলি বললেন, মৃত্যু নিশ্চিত না করেই কি কুলখানি করা যায়?
বক্কা বলল, যায়। আমরা মুনশি-মৌলবির সঙ্গে কথা বলেছি। কেউ ইচ্ছা করলে নিজের কুলখানির খানা খেতেও পারে।
ছক্কা বলল, চাচাজি, আপনি কি কুলখানিতে আসবেন?
মিসির আলি বললেন, না।
বক্কা বলল, সমস্যা নাই। টিফিন ক্যারিয়ারে করে আপনার আর জসুর খানা পাঠায়ে দিব।
মিসির আলি কিছু বললেন না। তিনি একদৃষ্টিতে দুই ভাইকে লক্ষ করছেন। তাদের অস্বাভাবিকতা সনাক্ত করার চেষ্টা। ভিডিও ক্যামেরায় ভিডিও করে রাখতে পারলে সুবিধা হতো। ভিডিও ক্যামেরা ছাড়াই মিসির আলি একটি বিষয় লক্ষ করলেন। এক ভাই যখন কথা বলে তখন অন্য ভাই ঠোঁট নাড়ে। যে কথা বলে তার দিকে দৃষ্টি থাকে বলে অন্যজনের ঠোঁট নাড়া চোখে পড়ে না।
ছক্কা বলল, চাচাজি, যদি অনুমতি দেন তাহলে উঠি। কাজকর্ম আছে।
মিসির আলি বললেন, অনুমতি দিলাম।
অনুমতি পাওয়ার পরেও দুই ভাইয়ের কেউই উঠছে না। বিরতিহীন পা নাচিয়েই যাচ্ছে। এখন দু’জনের দৃষ্টিই ছাদের দিকে। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে—ছাদে বিশেষ কিছু ঘটছে। ভীতিপ্ৰদ কিছু। তারা দু’জনই ভয় পাচ্ছে। একজন আরেকজনের পাশে সরে এসেছে।
কুলখানি উপলক্ষে
বিষ্যুদবার। কুলখানি উপলক্ষে আসরের নামাজের পর থেকে বিপুল আয়োজন চলছে। মাদ্রাসার দশজন তালিবুল এলেম কোরান খতম দিচ্ছে। তালেবুল এলেমদের আরেকটি দল তেঁতুলের বিচি নিয়ে বসেছে। তারা খতমে জালালি নিয়ে ব্যস্ত।
এশার নামাজের পর বড়খানা শুরু হলো। জসু বিশাল টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি করে খাবার নিয়ে চলে এসেছে। তার চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল। সে শুধু খাবার নিয়ে আসে নি, খেয়েও এসেছে।
ঝড়-বৃষ্টির কারণে কুলখানির অনুষ্ঠান সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হলো। রাত বারটা পর্যন্ত জিকিরের ব্যবস্থা ছিল। এগারটার মধ্যেই তালেবুল এলেমরা চলে গেল। মুনশি-মৌলবিরা খাওয়াদাওয়ার পরে অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করে ফেলেন।
মিসির আলি শুয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে বিছানায় শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শোনা তার পছন্দের একটি বিষয়। দরজা ধাক্কানোর শব্দে তিনি জাগলেন। দরজা খুলে দেখেন রেইনকোট পরা মল্লিক সাহেব। মল্লিক সাহেব আহত গলায় বললেন, আমার দুই হারামজাদার কাণ্ড দেখেছেন!! বাপ জীবিত, তার কুলখানি করে বসে আছে।
মিসির আলি বললেন, ভেতরে আসুন।
মল্লিক ঘরে ঢুকলেন। মিসির আলি বললেন, আপনি বাড়িতে গিয়েছিলেন, নাকি সরাসরি আমার এখানে এসেছেন?
বাড়িতে গিয়েছিলাম, আমাকে দেখে আমার দুই পুত্র দুই দিকে দৌড় দিয়ে পালায়া গেছে।
আপনি ছিলেন কোথায়?
বিষয়সম্পত্তির দেখভালের জন্যে গিয়েছিলাম।
ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন নি?
বড়টার সাথে একবার মোবাইলে কথা হয়েছে। তারপরেও দুই কুলাঙ্গার কুলখানি করে ফেলেছে। নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে।
কী মতলব থাকবে?
আমাকে খুনের পরিকল্পনা করেছে। সকালেই আমার মৃত্যুসংবাদ শুনবেন। কীভাবে মারবে তাও জানি। ধাক্কা দিয়ে কুয়াতে ফেলে দিবে।
মিসির আলি বললেন, আপনার কুয়ার মুখ তো বন্ধ। ফেলবে কীভাবে?
মল্লিক বললেন, এইটাই ঘটনা। ঘরে পা দিয়ে প্রথমেই গেলাম কুয়ার কাছে। মনে সন্দেহ, এইজন্যে গিয়েছি। গিয়ে দেখি কুয়ার মুখ খোলা। এরা কারিগর ডেকে খুলেছে।
মিসির আলি বললেন, বসুন, চা খান।
মল্লিক বললেন, চা খাব না। ক্লান্ত হয়ে এসেছি। স্নান করব, তারপর নিজের কুলখানির খানা খাব।
মিসির আলি বললেন, খাওয়াদাওয়ার পর যদি মনে করেন আমার সঙ্গে কথা বলবেন তাহলে চলে আসবেন। আমি জেগে থাকব।
আপনার জেগে থাকতে হবে না। আপনি ঘুমান। বটি হাতে নিয়ে আমি জেগে থাকব। দুইজনকে বটি দিয়ে কেটে চার টুকরা করব। কুয়ার ভেতর ফেলে কুয়া আটকে দিব। যেমন রোগ তেমন চিকিৎসা।
মিসির আলি বললেন, আপনি উত্তেজিত। উত্তেজনা কোনো কাজের জিনিস না। উত্তেজনা কমান। বসুন, গা থেকে রেইনকোট খুলুন। চা বানাচ্ছি, চা খান।
মল্লিক সাহেব গা থেকে রেইনকোটি খুললেন। হতাশ মুখে সোফায় বসলেন, নিজের মনে বিড়বিড় করতে লাগলেন, কেউ কোনোদিন শুনেছে ছেলে বাপ বেঁচে থাকতেই বাপের কুলখানি করে ফেলে? শুনেছে। কেউ? বাপের জন্মে। এই ঘটনা কখনো ঘটেছে?
চায়ে চুমুক দিয়ে মল্লিক সাহেব কিছুটা শান্ত হলেন।
মিসির আলি বললেন, আপনাকে মাঝে মাঝে ধূমপান করতে দেখি। উত্তেজনা প্রশমনে নিকোটিনের কিছু ভূমিকা আছে। একটা সিগারেট কি ধরাবেন?
বৃষ্টিতে সিগারেটের প্যাকেট ভিজে গেছে।
মিসির আলি তার প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। মল্লিক। সিগারেট ধরিয়ে আরও খানিকটা শান্ত হলেন। মিসির আলি বললেন, কখন থেকে আপনার দুই ছেলে আপনার কাছে অসহ্য হয়েছে?