শেষ পর্যন্ত ছোটভাই আবদুল গনি বক্কার শার্টের পকেট থেকে কাগজ বের হলো। পরিষ্কার ঝকঝকে হাতের লেখা। মানসিক প্রতিবন্ধীদের হাতের লেখা সুন্দর হয়। মিসির আলি বিজ্ঞাপনটা দু’বার পড়লেন।
সন্ধান চাই
আমাদের পিতাকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। কেউ সন্ধান দিলে তাকে কুড়ি হাজার টাকা নগদ পুরস্কার দেওয়া হইবে। কোনো পুলিশ ভাই যদি সন্ধান দেন, তিনিও পুরস্কারের দাবিদার হবেন। যদি কয়েকজন একত্রে সন্ধান দেন, তবে পুরস্কারের টাকা সমভাবে তাহদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। এই নিয়ে কোনো বিবাদ বিসংবাদ করা যাইবে না।
বিবাদ উপস্থিত হইলে আমাদের দুই ভাইয়ের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত গণ্য হইবে।
ইতি
শফিকুল গনি ছক্কা (বড়ভাই)
আবদুল গনি বক্কা (ছোটভাই)
মিসির আলি বললেন, হ্যান্ডবিলে কি তোমাদের বাবার ছবি যাবে?
জি-না, ছবি পাওয়া যায় নাই।
ছবি না পেলে তার একটা বৰ্ণনা দিতে হবে। তা না হলে মানুষ বুঝবে কীভাবে এ মল্লিক দেখতে কেমন। তোমাদের দুই ভাইয়ের নাম আছে, কিন্তু ঠিকানা কোথায়?
শফিকুল গনি বলল, ঠিকানা ইচ্ছা করে দেই নাই। ঠিকানা দিলে বাজে লোক ঝামেলা করবে। বলবে, এই জায়গায় দেখেছি। ওই জায়গায় দেখেছি।
মিসির আলি বললেন, ঠিকানা ছাড়া তোমাদের সন্ধান দিবে কীভাবে?
আবদুল গনি বলল, সন্ধান না দিলেও অসুবিধা হবে না।
মিসির আলি বললেন, আমি তোমাদের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। তোমাদের কাছে যদি মনে হয় বিজ্ঞাপন ঠিক আছে তাহলে ঠিক আছে।
দুই ভাই একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল। তাদের আনন্দিত মনে হচ্ছে।
মিসির আলি বললেন, যে সোফাটায় তোমরা এতক্ষণ বসে ছিলে সেটা তোমাদের। কাউকে পাঠিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করো।
শফিকুল গনি বলল, চাচাজি। এটা আপনার কাছে রেখে দিন। এটা আমার বাবার একটা স্মৃতি।
মিসির আলি বললেন, স্মৃতি বলছ কেন? তোমরা কি নিশ্চিত তিনি মারা, গেছেন?
দুই ভাই একসঙ্গে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
মৃত যদি তোমরা জানো তাহলে সন্ধান চেয়ে হ্যান্ডবিল ছাপাচ্ছ কেন?
শফিকুল গনি বলল, কেউ যেন না ভাবে আমরা সন্ধান করি নাই। চাচাজি যাই।
তোমরা হ্যান্ডবিলে ঠিকানা দাও নাই, এটা লোকজনের চোখে পড়বে না?
আবদুল গনি বলল, এটা নিয়ে কেউ কিছু মনে নিবে না। সবাই জানে আমরা বোকা।
মিসির আলি বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তিনি ব্যক্তিগত কথামালার খাতা খুললেন। ছক্কা-বক্কা দুই ভাই’ শিরোনামে কিছুক্ষণ লিখলেন। তাঁর লেখা—
ছক্কা বক্কা দুই ভাই
বাবা-মায়ের উদ্ভট মানসিকতার কারণে অনেক সন্তানদের উদ্ভট ডাকনাম নিয়ে সমাজে বাস করতে হয়। আমার জানা মতে, কিছু উদ্ভট ডাকনাম–নাট-বল্টু (দুই যমজ ভাই। বাবা বুয়েট থেকে পাস করা আর্কিটেক্ট)
ডেঙ্গু (এক ডাক্তার বাবার পুত্রের নাম)
অংক, মানসংক (বাবা স্কুলের অংক শিক্ষক। অংক ছেলের নাম, মানসংক মেয়ের নাম)
মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন। ছক্কা-বক্কা সম্পর্কে বেশি কিছু তিনি জানেন না।
জসুর কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেল। বুদ্ধি বিষয়ক তথ্য, তবে এই তথ্য ঘোলাটে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ছক্কা-বক্কা এই দুই ভাইয়ের বুদ্ধি কেমন?
জসু বলল, দুই ভাই যখন একত্রে থাকে তখন বুদ্ধি নাই। আলাদা যখন থাকে তখন বেজায় বুদ্ধি।
আলাদা কখন থাকে? দুপুরে দুই ভাই দেখি কলপাড়ে একসঙ্গে গোসল করে।
জসু বলল, মাঝেমধ্যে আলাদা হয়। ধরেন, বড়ভাইরে তার পরিবার ডাক দিল। সে চইল গেল। তখন ছোটভাই একলা।
মিসির আলি বললেন, এরা নাকি তাদের বাবাকে দুটা করে দেখে। এমন কিছু শুনেছিস?
শুনেছি। শুধু এই দুইজনই না। তাদের পরিবারও দেখেছে। ছোটভাইয়ের বউ একবার দুই শ্বশুর দেইখা ফিট পড়েছে। খাটের কোনায় লাইগা মাথা ফাটছে। হাসপাতালে নিতে হইছে। তয় এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর ফিট পড়ে না।
একই মানুষকে দু’জন দেখা বিষয়টাকে মিসির আলি তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। অপটিক্যাল হেলুসিনেশন। দৃষ্টি বিভ্রম। এই দুই ভাই তাদের দৃষ্টি বিভ্রম স্ত্রীদের কাছেও ছড়িয়ে দিয়েছে। সাইকোলজির পরিভাষায় এর নাম Induced hallocination
দৃষ্টি বিভ্রমের বড় শিকার স্কিজোফ্রেনিক রোগীরা। তাদের ব্রেইন কাল্পনিক ছবি তৈরি করে। রোগীরা সেই ইমেজ সত্যি মনে করে। তারা যে বাস্তবতায় বাস করে তার নাম Distorted reality.
স্কিজোফ্ৰেনিক রোগীদের ধর্মকর্মে প্রবল আসক্তি থাকে। এই দুই ভাইয়ের তা আছে। সারা দিন এরা নামাজ পড়ে না। সন্ধ্যার পর বারান্দায় জয়নামাজ বিছিয়ে বসে। অনেক রাত পর্যন্ত নামাজ পড়ে। জিকির করে।
মিসির আলি জসুকে জিজ্ঞেস করলেন, এই দুই ভাই মানুষ কেমন?
জসু বলল, অত্যধিক ভালো। সবার সাথে তাদের মধুর ব্যবহার। একটা ঘটনা বললে বুঝবেন। এই দুই ভাই গলির সামনের স্টলে চা খাইতেছে, এমন সময় আমি সামনে দিয়া যাই! বড়ভাই আমারে হাত উচায়ে ডাকল। মধুর গলায় বলল, জসু! আমরার সাথে এক কাপ চা খাও। যদি না খাও মনে কষ্ট পাব। এই ঘটনা শুধু যে আমার জীবনে ঘটেছে তা না। অচেনা অজানা মানুষের সাথেও ঘটেছে। অনেক ফকির মিসকিনও দুই ভাইয়ের সঙ্গে চা খেয়েছে।
এই বিষয়টা স্কিজোফ্ৰেনিয়ার রোগীদের ক্ষেত্রে কখনো ঘটে না। তারা কারও সঙ্গে মেশে না। আলাদা থাকে। তাদের বাস্তবতা আলাদা বলেই সাধারণ বাস্তবতার মানুষদের সঙ্গে মিশতে পারে না।
‘সন্ধান চাই? হ্যান্ডবিল ছাপা হয়েছে। হ্যান্ডবিলে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। এ মল্লিক কচ্চি হাউসের ঠিকানা। হ্যান্ডবিল ফার্মগেটে বিলি হচ্ছে। কাচ্চি হাউসের কাস্টমারদেরও দেওয়া হচ্ছে।