কিছুটা রাগ করেছি। এখন বিশ্বাস পরে অবিশ্বাস, এটা কেমন কথা? আমার দুই পুত্ৰ যে আমাকে নিয়ে নানান কথা ছড়ায়, এটা নিশ্চয় জানেন?
জানি না।
আপনাকে কখনো কিছু বলে নাই?
জি-না। তাদের সঙ্গে আমার কখনো কথাবার্তা হয় না। এদের দূর থেকে দেখি।
এরা আমার বিষয়ে ছড়ায়েছে যে, আমাকে নাকি দুটা করে দেখে।
মিসির আলি বললেন, দুটা মানে বুঝলাম না।
মল্লিক বললেন, দুইজন আমি আমার ঘরে বসে আছি। এই রকম। সত্য কখনো কেউ বিশ্বাস করে না। অসত্য কথা, ভুল কথা, বানোয়াট কথা সবাই বিশ্বাস করে। এই দুই কুপুত্রের কারণে সবাই বিশ্বাস করে দুইজন মল্লিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ও আচ্ছা
এত বড় একটা কথা বললাম, আপনি ‘ও আচ্ছা’ বলে ছেড়ে দিলেন? আপনি কি আমার দুই কুপুত্রের কথা বিশ্বাস করেছেন?
না।
মল্লিক সাহেব বললেন, সব কথাই আপনি প্রথমে বিশ্বাস করেন, এই কথাটা কেন করলেন না?
মিসির আলি বললেন, বিশ্বাস করি নি, কারণ আমি দুইজন মল্লিককে দেখছি না। তা ছাড়া আপনার দুই পুত্রের কেউ আমাকে এ ধরনের কথা বলে নি।
তারা যদি বলত, আপনি বিশ্বাস করতেন?
প্ৰথমে অবশ্যই বিশ্বাস করতাম। তারপর চিন্তা-বিশ্লেষণে যেতাম। অ্যারিস্টটল একবার বললেন, মানুষের মস্তিষ্ক রক্ত পাম্প করার যন্ত্র। এক শ বছর মানুষ তা-ই বিশ্বাস করেছে। এক শ বছর পর অবিশ্বাস এসেছে।
অ্যারিস্টটল লোকটা কে?
একজন দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী।
দার্শনিক, বিজ্ঞানী সবই ফালতু।
আপনার কাছে মনে হতে পারে।
মল্লিক সাহেব হঠাৎ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কিছু সময়ের জন্যে ঝিম ধরে গেলেন।
মিসির আলি বললেন, একটা সিগারেট কি খাবেন?
মল্লিক সাহেব বললেন, না। নিজের ঘরে গিয়ে আরাম করে সিগারেট খাব। আপনার এখানে না। আপনাকে শেষ কথা বলি—আমি কিন্তু সত্যি মৃত মানুষ দেখতে পাই। তাদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলি। আপনার ঘরেও একজন মৃত পুরুষ দেখি। হাবে-ভাবে মনে হয়। সে আপনার পিতা।
ও আচ্ছা।
মল্লিক সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, এত বড় একটা কথা বললাম, আর আপনি ও আচ্ছা’ বলে ছেড়ে দিলেন? আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসাই ভুল হয়েছে।
মল্লিক সাহেব ঘর থেকে বের হলেন। তিনি ছাতা নিয়ে এসেছিলেন, যাওয়ার সময় ছাতা ছাড়াই বৃষ্টিতে নেমে গেলেন।
মল্লিক সাহেবের আর কোনো খোজ-খবর পরের এক মাসে পাওয়া গেল না। জলজ্যান্ত একজন মানুষ পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেল।
ছক্কা-বক্কা দুই ভাই পরিবার নিয়ে ফাঁকা বাড়িতে ফিরে এল। আবার তাদের দু’জনকে ছেলে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গেল। বাবার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, এতে তাদের দুঃখিত বা চিন্তিত মনে হলো না। মল্লিক পরিবারের সব কর্মকাণ্ড আগের মতোই চলতে লাগল। বক্কার ছোট ছেলের আকিকার অনুষ্ঠানের দিন ধার্য হলো। আকিকা হলো। জসুকে আকিকার মাংস দেওয়া হলো।
বক্কার ছোট ছেলের নাম রাখা হলো, সৈয়দ শাহ আমিনুর রহমান বখতিয়ার খিলজি’।
ওজনদার নাম রাখতে পারার আনন্দে বক্কাকে অভিভূত বলে মনে হলো।
মল্লিক সাহেবের দুই পুত্ৰ
মল্লিক সাহেবের দুই পুত্ৰ মিসির আলির সামনে বসে আছে। তাদের বসার ভঙ্গি আড়ষ্ট, দৃষ্টি এলোমেলো। তবে এলোমেলো দৃষ্টিতেও শৃঙ্খলা আছে। এক ভাই ছাদের দিকে তাকালে, অন্য ভাইও ছাদ দেখে। ছাদ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে একজন যদি জানোলা দিয়ে তাকায়, অন্যজনও জানালার দিকে তাকায়। কে কাকে অনুসরণ করছে? মিসির আলির কাছে স্পষ্ট না। কেউ কাউকে অনুসরণ করছে এ রকমও মনে হচ্ছে না। সম্ভবত যা করছে একসঙ্গে করছে।
দুই ভাইয়ের চেহারায় কোনো মিল নেই। বড়ভাই (শফিকুল গনি ছক্কা) শ্যামলা, মোটাসোটা, বেঁটে। ছোটভাই (আবদুল গনি বক্কা) ফর্সা, রোগা পাতলা এবং লম্বা। দু’জনেরই গোফ আছে। লুঙ্গির ওপর হাফ হাতা শার্ট। একই রঙের লুঙ্গি (সবুজ), একই রঙের শার্ট (কমলা)। মিসির আলি মনে করার চেষ্টা করলেন এরা আগেও মিল করে শার্ট পরত কি না। তাদের জুতাও একই রকম-কালো রাবারের জুতা।
শফিকুল গনি বলল, চাচা, ভালো আছেন? মিসির আলি বললেন, ভালো আছি।
আবদুল গনি বলল, একটা কাগজ আপনাকে দেখাতে এনেছি। আপনার পরামর্শ দরকার।
মিসির আলি বললেন, কাগজ দেখাও।
দুই ভাই চুপ করে বসে রইল। কোনো কাগজ বের করল না। দু’জনই ডান পা নাচাচ্ছে এবং অতি দ্রুত নাচাচ্ছে। মিসির আলি এর আগে কাউকে এত দ্রুত পা নাচাতে দেখেন নি।
শফিকুল গনি বলল, একটা হ্যান্ডবিল ছাপাব, লেখা ঠিক আছে কি না। যদি দেখে দেন।
মিসির আলি বললেন, দেখে দিব। কাগজটা দাও।
এবারও কাগজ বের হলো না। দুই ভাই আগের নিয়মে পা নাচাচ্ছে, তবে এবার নাচাচ্ছে বা পা। মিসির আলি কাগজের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ভাবছেন এই দুই ভাই মানসিক প্রতিবন্ধী কি না। সম্ভাবনা প্রবল। কাগজটা দেখে দিন বলার পরও তারা কাগজ বের করছে না-এটা মানসিক ক্ষমতার অভাবই বোঝায়।
তোমরা চা খাবে?
দু’জন একই সঙ্গে না-সূচক মাথা নাড়ল।
তোমাদের বাবার কোনো খোঁজ কি পাওয়া গেছে?
দু’জন আবারও একই সঙ্গে না-সূচক মাথা নাড়ল।
কাগজের কথা বলছিলে, কাগজটা কি আসলেই দেখাবে?
দু’জন একই সঙ্গে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল, তবে কাগজ বের করল না।
জসু ট্রে নিয়ে ঢুকেছে। ট্রেতে তিন কাপ চা। দুই ভাই আগে চা খাবে না। বলেছে, এখন দু’জন একই সঙ্গে অতি দ্রুত চায়ের কাপ নিল এবং অতি দ্রুত চা শেষ করল। প্রায় শরবত খাওয়ার মতোই বড় বড় চুমুক দিল। মিসির আলি এই দুই ভাইয়ের মতো এত দ্রুত গরম চা কাউকে খেতে দেখেন নি।