মিসির আলি বললেন, আপনার ছেলে দুটা মনে হয় সেরকম হবে না। তারা সারাক্ষণই বাচ্চাদের কোলে নিয়ে থাকে।
এই দুই গাধার কথা তুলবেন না। এদের নাম শুনলে মাথায় রক্ত উঠে যায়।
মিসির আলি বললেন, আপনার ছেলে দুটার নাম কি আপনার দেওয়া?
আর কে দেবে? নাম ভালো দিয়েছি না? একজন ছক্কা আরেকজন বক্কা। ছক্কা বড়, বক্কা ছোট।
মিসির আলি বললেন, নাম দেওয়া থেকেই বোঝা যায় আপনার ছেলে দু’জনের জন্যে মমতা নাই।
মল্লিক সাহেব তিক্ত গলায় বললেন, ওদেরও নাই। নাই-এ নাই-এ কাটাকাটি। আরেক কাপ চা খাব, যদি আপনার তকলিফ না হয়।
আমার তকলিফ হবে না। আপনি আরাম করে চা খাচ্ছেন দেখে ভালো লাগছে।
মল্লিক সাহেব বললেন, আপনার বসার ঘরের সোফায় আমি যদি শুয়ে থাকি তাহলে সমস্যা হবে?
মিসির আলি বললেন, কোনো সমস্যা হবে না। তবে ভাই, আমার বসার ঘরে সোফা নাই।
সোফা আমি আনায়ে নিব।
মিসির আলি এখন বুঝতে পারছেন, মল্লিক সাহেব তাঁর এখানে থাকতে এসেছেন। ‘সদর দরজা খোলা’ এই সাবধান বাণী ঘরে ঢোকার অজুহাত।
মল্লিক সাহেবের তাঁর ঘরে রাত্রিযাপনের বিষয়টা মিসির আলির কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। একা ঘুমাতে ভয় পাচ্ছেন, তা ঠিক আছে। খালি বাড়িতে অনেকেই একা ঘুমাতে ভয় পায়। কিন্তু মল্লিক সাহেবের বাড়ি খালি না। পরিবারের লোকজন চলে গেলেও অনেকেই এখনো আছে। বাড়ির দারোয়ান আছে, কাজের লোক আছে।
দ্বিতীয় কাপ চা মল্লিক সাহেব আগের মতোই তৃপ্তি করে খাচ্ছেন। এর মধ্যে তাঁর লোকজন বসার ঘরে সোফা নিয়ে এসেছে। বালিশ চাদর এনেছে। মল্লিক সাহেব সব ব্যবস্থা করেই এসেছেন।
মিসির আলি বললেন, আপনি কি বিশেষ কোনো কারণে বাড়িতে একা থাকতে ভয় পাচ্ছেন?
মল্লিক সাহেব হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
কারণটা বলতে চাইলে বলতে পারেন।
বলতে চাই না।
তাহলে চা শেষ করে শুয়ে পড়ুন। আপনার সকাল সকাল ঘুমানোর অভ্যাস।
সবদিন সকাল সকাল ঘুমাই না। মাঝে মাঝে রাত জাগি। সারা রাতই জেগে থাকি।
আজ কি সারা রাত জাগিবেন?
হুঁ। আপনি ঘুমায়ে পড়েন।
মিসির আলি বললেন, সময় কাটানোর জন্য আপনাকে বই দেব?
গল্প-উপন্যাস আমি পড়ি না। বানানো কিচ্ছাকাহিনি। কথায় কথায় প্ৰেম। গল্প-উপন্যাস পড়লে মনে হয় দেশে প্রেমের হাট বসে গেছে। স্কুলে প্ৰেম, কলেজে প্রেম, ইউনিভার্সিটিতে প্ৰেম, অফিসে প্ৰেম, আদালতে প্রেম। ফালতু বাত।
মিসির আলি বললেন, প্রেম ছাড়াও আমার কাছে বিজ্ঞানের কিছু সহজ বই আছে।
মল্লিক সাহেব বললেন, বিজ্ঞান তো আরও ফালতু। আমাকে বইপত্র কিছু দিতে হবে না। আপনি আপনার মতো ঘুমান। আপনাকে শুধু একটা কথা বলে রাখি, ছক্কা-বক্কা এই দুইয়ে মিলে আমাকে খুন করবে। যদি খুন হই পুলিশের কাছে এদের নামে মামলা দিবেন।
মিসির আলি বললেন, পুলিশ আমার কথায় তাদের আসামি করবে না।
টাকা খাওয়ালেই করবে। টাকা খাওয়াবেন। আমি চাই ছক্কা-বক্কা দুইটাই যেন ফাঁসিতে ঝুলে।
আপনি যে-কোনো কারণেই হোক উত্তেজিত হয়েছেন। ঘুমিয়ে পড়ুন। ভালো ঘুম হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
এই দুই ভাই সাক্ষাৎ শয়তান। বুঝার উপায় নাই। নিজের মাকে মেরেছে। ধাক্কা দিয়ে কুয়াতে ফেলে মেরেছে। প্রথমে বুঝতে পারি নাই। মামলা মোকদ্দমা হয় নাই। কীভাবে হবে বলেন! দুই ভাই কেঁদে কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলেছিল। কিছুক্ষণ পর পর ফিট মারে। উপায়ান্তর না দেখে দুইজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম, তখন তো জানি না। দুই ভাই মিলে এই কীর্তি করেছে।
যখন জানলেন তখন পুলিশের কাছে গেলেন না কেন?
ছয় বছর পর জেনেছি। ছয় বছর আগের ঘটনা পুলিশ মুখের কথায় বিশ্বাস করবে। কেন? তারপরও বলেছি। রমনা থানার ওসি বাড়িতে এসেছেন। দুই ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। দুই ভাই চিৎকার করে এমন কান্না শুরু করল, বাড়িতে কাজ-কাম থেমে গেল। কাঁদতে কাঁদতে দুই জনই ফিট। ওসি সাহেব তখন তাদের উল্টা সাত্ত্বনা দেয়। বলে কী, তোমাদের বাবার বয়স হয়েছে। বয়সের কারণে মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা ঢুকে। তোমরা কিছু মনে নিয়ে না। আমাকে তিনি যখন বললেন তখনো বিশ্বাস করি নাই। ছেলের হাতে বাবা সম্পত্তির কারণে খুন হন। মা কখনো না।
মিসির আলি বললেন, আপনি কীভাবে জানলেন ছেলেরা মাকে খুন করেছে?
তাদের মা আমাকে বলেছে।
মৃত মা বলেছে?
জি। আমার একটা বিশেষ ক্ষমতার কথা আপনাকে বলা হয় নাই। আমি মাঝে মধ্যে মৃত মানুষ দেখতে পাই। তাদের সঙ্গে বাত-চিতও করি।
ও আচ্ছা।
আমার কথা মনে হয় এক ছটাকও বিশ্বাস করেন নাই।
মিসির আলি বললেন, শুরুতে আমি সবার কথাই বিশ্বাস করি। অবিশ্বাস পরের ব্যাপার।
মৃত মানুষদের সঙ্গে যে আমার কথাবার্তা হয়, এটা বিশ্বাস করেছেন?
জি বিশ্বাস করছি। এটা এক ধরনের ডিলিউশন।
ডিলিউশন জিনিসটা কী?
ভ্ৰান্ত ধারণা। যে ধারণার শিকার সে মানসিক রোগী। আমরা সাইকোলজিষ্টেরা মনে করি তার চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন।
মল্লিক সাহেব ক্রুদ্ধ গলায় বললেন, আমার চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন?
মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ।
মল্লিক সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। বিরক্ত গলায় বললেন, আপনাকে অনেক বিরক্ত করেছি, এখন চলে যাব। দরজা বন্ধ করে দেন, আমি নিজের বাড়িতে থাকব।
আমার এখানে থাকবেন না?
না।
জসুকে কি তুলে দিব? আপনার সঙ্গে ঘুমাবে?
প্রয়োজন নাই। নবাবের বাচ্চা ঘুমাইতেছে ঘুমাক।
আপনি মনে হয় আমার ওপর রাগ করেই চলে যাচ্ছেন।