মিসির আলি সাহেব।
জি।
ব্যবস্থা করে দেন।
কী ব্যবস্থা করব?
আমি আমার এই দুই বন্দপুত্রকে শায়েস্তা করব। এই দুইজনকে ন্যাংটা করে বাড়ির সামনে যে সাইনবোর্ড আছে, সেই সাইনবোর্ডের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখব। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা এই অবস্থায় থাকবে। এটা আমার ফাইনাল ডিসিশান।
মিসির আলি বললেন, চা খান। একটু চা দিতে বলি?
আজিজ মল্লিক বললেন, এই দুই বদকে শিক্ষা না দিয়ে আমি কিছু খাব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখনো নাশতা খাই নাই। এরা কত বড় বদ চিন্তা করেনবাপের টাকা চুরি করে ? কোনো আয় নাই, রোজগার নাই, দুইজনে গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে। বউ-বালবাচ্চা নিয়ে বাপের ঘরে খায়, আবার বাপের টাকা চুরি করে।
আপনি কি নিশ্চিত যে, এরাই টাকা চুরি করেছে?
অবশ্যই। কাগজ কলম আনেন লিখে দেই।
চুরিটা কে করেছে? বড়জন, না ছোটজন?
দুই ভাই একসঙ্গে মিলে করেছে। এরা যা করে একসঙ্গে করে। এখন শাস্তিও একসঙ্গে হবে। থাক ন্যাংটা হয়ে।
মিসির আলি বিনীতভাবে বললেন, ভাই সাহেব, এক কাপ চা আমার সঙ্গে খান। জসু খুব ভালো রং চা বানায়।
আপনাকে তো একবার বললাম, দুই কুসন্তানকে শাস্তি না দিয়ে আমি কিছু খাব না। এক জিনিস বারবার কেন প্যাঁচাচ্ছেন?
সরি।
ইংরেজি এক কথা সবাই শিখেছে-‘সরি’। সরি দিয়ে কী হয়? সরি বলে কিছু নাই। পাপ করবে। পানিশমেন্ট হবে। সরি আবার কী?
মল্লিক সাহেব পুত্রদের সন্ধানে বের হয়ে গেলেন। তাদের কাউকে পাওয়া গেল না। এরা সকালবেলাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। দোতলা থেকে মেয়েদের কান্নার শব্দ আসতে লাগল। নিশ্চয়ই ছেলেদের দুই বউ কাঁদছে। জসু এসে খবর দিল-মল্লিক সাহেব ছেলের বউদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন বলেই কান্নাকাটি শুরু হয়েছে।
দুপুরের মধ্যে বাড়ি খালি হয়ে গেল। ছেলের বউরা কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেল। তাদের পেছনে পেছনে গেলেন মল্লিক সাহেবের স্ত্রী (দ্বিতীয়জন, প্ৰথমজন মারা গেছেন), তার কাজের দুই মেয়ে। মল্লিক সাহেব উঠানে দাঁড়িয়ে চোঁচাতে লাগলেন, যারা গেছে তারা যদি ফিরে আসতে চায় তাহলে তাদের এই উঠানে দশবার করে কান ধরে উঠবোস করতে হবে। কান ধরে উঠবোস, তারপর বাড়িতে ঢোকার টিকিট। আমি এ মল্লিক। আমার কথাই এ বাড়িতে আইন।
মিসির আলি চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে এ মন্ত্রিক পরিবারের সদস্যদের বিদায়-দৃশ্য দেখছেন। এই দৃশ্য তাঁর কাছে নতুন না। আগেও দু’বার দেখেছেন।
জসু ঘুমিয়ে পড়েছে
রাত দশটা। জসু ঘুমিয়ে পড়েছে। সদর দরজা লাগাতে ভুলে গেছে। দরজা খোলা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, খোলা দরজা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছে। ‘বৃষ্টিকণিকা নিয়ে ঠান্ডা বাতাসের আগমন’ এই বাক্যটা মিসির আলির মাথায় ঘুরছে। মাঝে মাঝে গানের কলি মাথায় ঢুকে যায়। সারাক্ষণ বাজতে থাকে। এই বাক্যটাও সেরকম। মিসির আলি বাক্যটা মাথা থেকে দূর করতে চাচ্ছেন। অ্যান্টিমেটারের জগৎ নিয়ে লেখা বইটা পড়বেন। মাথা ঠান্ডা রাখা প্রয়োজন। কোনো একটা বাক্য মাথার ভেতর ঘুরলে মাথা ঠান্ডা থাকে কীভাবে?
মিসির আলি সাহেব, জেগে আছেন?
মল্লিক সাহেবের গলা। মিসির আলি বললেন, জেগে আছি।
আপনার দরজা খোলা। আমি ভাবলাম দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। আপনি আজিব আদমি। আপনার পক্ষে সবই সম্ভব।
মল্লিক সাহেব! ভেতরে আসুন।
ভেতরে আসব না। দরজা বন্ধ করুন, আমি চলে যাব। দরজা খোলা রেখে ঘুমানো ঠিক না। চোর এসে সাফা করে দিয়ে যাবে। ভালো কথা, আপনার কাজের ছেলে জসু কি জেগে আছে?
জি-না। কেন বলুন তো?
এক ভয় ভয় লাগছে। সে জেগে থাকলে তাকে নিয়ে যেতাম।
বলতে বলতে মল্লিক সাহেব ঘরে ঢুকলেন। মিসির আলির বিছানার পাশে রাখা কাঠের চেয়ারে বসলেন।
মিসির আলি বললেন, চা খাবেন? একটু চা করি।
চা খাওয়া যায়।
মিসির আলি বিছানা থেকে নামলেন। মল্লিক সাহেব বললেন, আপনি কেন যাচ্ছেন? জসুকে পাঠান।
বেচারা আরাম করে ঘুমাচ্ছে।
মুনিবের প্রয়োজন আগে, তারপর নফরের ঘুম। পাছায় লাত্থি দিয়ে এর ঘুম ভাঙান।
মিসির আলি কিছু না বলে রান্নাঘরে ঢুকলেন। একবার ভাবলেন বলেন, মুনিব-নফরের বিষয়টা ঠিক না। অল্পদিনের জন্যে আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি। এখানে আমরা সবাই নফর। মুনিব কেউ না। যদিও রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁর ধারণা, আমরা সবাই রাজা। কিছুই বলা হলো না। উচ্চমার্গের কথা মল্লিক সাহেবের সঙ্গে বলা অর্থহীন। মল্লিক সাহেবের অবস্থান নিম্নমার্গে।
মল্লিক সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, চা ভালো বানিয়েছেন। বাংলাদেশ চায়ের দেশ। এখানে কেউ চা বানাতে পারে না। সবাই বানায় পিশাব। দিনে আট-দশ কাপ পিশাব খাই।
আপনার নাতির খবর কী?
কোন নাতি? নাতি তো একটা না, এক হালি।
আমি তো জানতাম দুই ভাইয়ের দুই ছেলে।
ভুল জানতেন। এরা দুই ছেলে কোলে নিয়ে ঘুরে, মেয়ে দুইটা ঘরে থাকে। এখন বলেন কোনটার কথা জানতে চান?
যার নিউমোনিয়া হয়েছিল।
ও আচ্ছা, কিসমতের কথা জানতে চান? আমি কোনো খবর জানি না। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর আর খোঁজ নেই নাই।
ওরা টেলিফোন করে নাই?
আমাকে কি টেলিফোন করার সাহস এদের আছে? আমার গলার শব্দ শুনলে পিশাব করে দেয়, এমন অবস্থা।
বলেন কী?
এইটা আমরা বংশপরম্পরায় পেয়েছি। আমার বাবার খড়মের শব্দ শুনলেও আমি দৌড়ে পালাতাম। দুই একবার প্যান্টে ‘ইয়েও’ করেছি।