সে একা ঘুমালেই নাকি একটা মেয়ে-ভূত এসে জাসুর পায়ের তলা চাটে। মেয়ে-ভূতটার নাম হুড়বুড়ি।
মনোবিশ্লেষণের মাধ্যমে হুড়বুড়ির কাটা জসুর মাথা থেকে দূর করা প্ৰয়োজন। মিসির আলি সময় পাচ্ছেন না।
সময় পাচ্ছেন না কথাটা ঠিক না। তার হাতে কোনো কাজ নেই। তিনি প্রচুর বই পড়ছেন। বই পড়া কাজের মধ্যে পড়ে না। বই পড়া হলো বিনোদন।
মিসির আলির ঘুমুতে যাওয়ার কোনো ঠিকাঠিকানা নেই। জাসুর আবার এই বিষয়ে ঘড়ি ধরা স্বভাব। রাতের খাবারের পর থেকে সে হাই তুলতে থাকে। হাই তুলতে তুলতে বাড়িওয়ালার বাড়িতে (দোতলায়)। টিভি দেখতে যায়। রাত ন’টার দিকে ফিরে এসে চা বানায়। আগে এক কাপ বানােত, এখন বানায় দু কাপ। মিসির আলি যেমন বিছানায় পা ছড়িয়ে খাটের মাথায় হেলান দিয়ে চা খান, সেও তা-ই করে। চা শেষ করে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুম।
আজও তা-ই হচ্ছে। দু’জনই গম্ভীর ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। মিসির আলি দিনের শেষ সিগারেট ধরিয়েছেন। তার হাতে পপুলার সায়েন্সের একটা বই, নাম–The Other Side of Black Hole। লেখক প্রমাণ করতে চেষ্টা করছেন ব্ল্যাক হোলের ওপাশের জগতটা পুরোটাই অ্যান্টিমেটারে তৈরি। সেখানকার জগৎ অ্যান্টিমেটারের জগৎ। এই জগতে যা যা আছে অ্যান্টিমেটারের জগতেও তা-ই আছে। সেই জগতে এই মুহূর্তে একজন মিসির আলি চা খেতে খেতে Theother Side of Black Hole বইটা পড়ছে। তার সঙ্গে আসে জসু নামের এক ছেলে।
মিসির আলি বই নামিয়ে হঠাৎ করেই জলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, জসু, তুই একটু বাড়িওয়ালার বাসায় যেতে পারবি?
জসু বলল, কী প্রয়োজন বলেন?
মিসির আলি বললেন, খোজ নিয়ে আয় এই বাড়ির কেউ অসুস্থ কি না। আমার ধারণা, বাড়ির কেউ অসুস্থ, তাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিকের একটা ডোজ পড়ে রাত তিনটায়। তখন ঘড়িতে অ্যালাৰ্ম দেওয়া থাকে। রাত তিনটায় অ্যালার্ম বাজে, তখন সেই শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। আমার ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়। দশ মিনিট বাড়তি লাগে।
জসু বলল, বাড়িওয়ালার নাতির নিউমোনিয়া হয়েছে। তার নাম কিসমত। ছক্কা ভাইজানের ছেলে।
মিসির আলি বললেন, তারপরেও যা। জেনে আয় রাত তিনটায় অ্যালার্ম বাজে কি না।
জসু বলল, বাদ দেন তো স্যার। বাজে প্যাচাল।
মিসির আলি বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে যা বাদ দিলাম।
জসু ঘুমুতে গেল। মিসির আলি রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে বসে রইলেন।
জসু ঘুমুতে গেল। মিসির আলি রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে বসে রইলেন। অ্যালার্ম বাজল তিনটা দশ মিনিটে। মিসির আলির ভুরু কুঁচকে গেল। বাড়িওয়ালার ঘড়ি ফার্স্ট, নাকি তারটা স্লো—এটা নিয়ে ভাবতে বসলেন।
মিসির আলির বাড়িওয়ালার নাম আজিজুর রহমান মল্লিক। তিনি পেশায় একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। এই বাড়িতেই (একতলা দক্ষিণ দিকে) তাঁর রোগী দেখার চেম্বার। পুরুষ ও মহিলা রোগীদের বসার ব্যবস্থা আলাদা। সিরিয়াস রোগী, যাদের সার্বক্ষণিকভাবে দেখাশোনা করা দরকার, তাদের জন্য একটা ঘরে দুইটা বিছানা পাতা আছে। এটা তার হাসপাতাল। হাসপাতালে একজন নার্স আছে। এই ঘরের পাশেই হোমিও ফার্মেসি। রোগীদের এই ফার্মেসি থেকেই ওষুধ কিনতে হয়। বাইরে সব ওষুধই দু নম্বরি। আজিজুর রহমান মল্লিক সব ওষুধ সরাসরি হোমিওপ্যাথের জনক হানিম্যান সাহেবের দেশ জার্মানি থেকে আনান।
বাড়ির সামনে ১০ ফুট বাই ৪ ফুটের বিশাল সাইনবোর্ড। সেখানে লাল, সবুজ এবং কালো রঙের লেখা
সুরমা হোমিও হাসপাতাল
ডা. এ মল্লিক
এমডি
গোন্ড মেডেল (ডাবল)
মিসির আলি আজিজ মল্লিক সাহেবের বাড়ির একতলায় উত্তর পাশে গত এক বছর ধরে আছেন। গত এক বছরে তিনি রোগীর কোনো ভিড় লক্ষ করেন নি। তার ধারণা মানুষজন হােমিওপ্যাথি চিকিৎসার ওপর এখন আর তেমন ভরসা। করছে না।
রোগী না থাকলেও মল্লিক সাহেবের আর্থিক অবস্থা ভালো। তার ছয়টা সিএনজি বেবিট্যাক্সি আছে, চারটা রিকশা আছে। সম্প্রতি একটা ট্রাক কিনেছেন। আগারগাঁও বাজারে কাঁচ্চি বিরিয়ানির দোকান আছে। দোকানের নাম ‘এ মল্লিক কচ্চি হাউস’। কাঁচ্চি হাউসের বিরিয়ানির নামডাক আছে। সন্ধ্যাবেলা দুই হাঁড়ি কচ্চি বিরিয়ানি রান্না হয়। রাত আটটার মধ্যে শেষ হয়ে যায়।
মল্লিক সাহেবের দুই ছেলে। দু’জনেরই বিয়ে হয়েছে। তারা বউ-বাচ্চা নিয়ে বাবার সঙ্গে থাকে। দু’জনের কেউ কিছু করে না। তাদের প্রধান কাজ, বাচ্চা কোলে নিয়ে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করা। বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়া। দুই ভাইয়ের মধ্যে যথেষ্ট আন্তরিকতা। তারা যখন রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে একসঙ্গে করে। চায়ের দোকানে সবসময় পাশাপাশি বসে চা খায়। পরিচিত কাউকে দেখলে দুই ভাই একসঙ্গে মাথা নিচু করে ফেলে। তারা তাদের বাবার ভয়ে যেমন অস্থির থাকে, পরিচিতদের ভয়েও অস্থির থাকে।
সকাল আটটা। মল্লিক সাহেব মিসির আলির ঘরে বসে আছেন। মল্লিক সাহেবের বয়স ষাটের কাছাকাছি। চেহারা বিশেষত্বহীন। নাকের নিচে পুরুষ্ট গোফ আছে। মাথা কামানো। তার চেহারা, চলাফেরা, কথা বলার ভঙ্গিতে কার্টুনভাব আছে। মল্লিক সাহেবকে আজ অত্যন্ত গম্ভীর দেখাচ্ছে। দ্রুত পা নাচাচ্ছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, তার ওপর দিয়ে বিরাট ঝড় বয়ে গেছে কিংবা এখনো যাচ্ছে। মল্লিক সাহেব মানুষটা ছোটখাটো। রাগে ও উত্তেজনায় তিনি আরও ছোট হয়ে গেছেন। তাঁর শোবার ঘর থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডেল চুরি গেছে। তার ধারণা টাকাটা দুই ছেলের কোনো-একজন নিয়েছে। রাগ ও উত্তেজনার প্রধান কারণ এইটাই। এই পরিস্থিতিতে কী করা যায়, তিনি তা জানতে এসেছেন। মিসির আলির বিচার-বুদ্ধির ওপর তার আস্থা আছে।