আমি একপর্যায়ে জীবিত এবং মৃত মল্লিকের DNA পরীক্ষা নিজ খরচে করতে চেয়েছিলাম, তাও সম্ভব হলো না। পরীক্ষাটা হয় সিঙ্গাপুরে। যে পরিমাণ অর্থ পরীক্ষার জন্যে প্রয়োজন, তা আমার ছিল না।
আমি নিজেও মনে হয় মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছি। প্রায়ই যে ঘরে বন্দি ছিলাম সেই ঘর স্বপ্নে দেখি। স্বপ্নে লাল টেলিফোন বাজতেই থাকে। আমি টেলিফোন ধরতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় একজন বলে–DNA টেস্ট করা হয়েছে। রিপোর্ট লিখে নিন। জীবিত এবং মৃত দু’জনের একই DNA, অর্থাৎ দু’জন একই ব্যক্তি।
স্বপ্ন আর কিছুই না, আমার নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন। আমি কি তাহলে ভাবছি, মৃত এবং জীবিত একই মানুষ? এর মানেই বা কী?
আমি মুন হাউস হোটেলের ২১২ নম্বর ঘরে এখনো আছি। কাক-দম্পতির ওপর লক্ষ রাখছি। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়েছে। কাক-দম্পতির সে-কী আনন্দ! তাদের আনন্দ দেখে মল্লিক পরিবারের জটিলতা ভোলার চেষ্টা করছি। যখন মনে হয় পুরোপুরি ভুলে গেছি, তখনই স্বপ্নে লাল টেলিফোন বেজে ওঠে। কেউ-একজন বলে, জীবিত এবং মৃত মল্লিক একই ব্যক্তি। প্লিজ, টেক নোট।
মিসির আলি অসুস্থ
মিসির আলি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি কিছু খেতে পারেন না। রাতে ঘুমুতেও পারেন না। যখন চোখে ঘুম নেমে আসে, তখনই লাল টেলিফোন বাজতে থাকে। তিনি লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসেন।
মিসির আলি তাঁর অসুখের কারণ ধরতে পেরেছেন। মল্লিক পরিবারের রহস্য সমাধানে তার ব্যর্থতা। নিজেকে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন-ব্যর্থতা সফলতারই অংশ। দাবায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকেও কখনো কখনো হার মানতে হয়। যেখানে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদেরই এই অবস্থা, সেখানে তার অবস্থান কোথায়! সাইকোলজির খেলায় তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন না। অনেক রহস্য তিনি ভেদ করেছেন, আবার অনেক রহস্যেরই কিনারা করতে পারেন নি। তার একটি খাতা আছে যার শিরোনাম ‘অমীমাংসিত রহস্য’। যেসব রহস্যের তিনি কিনারা করতে পারেন নি, তার প্রতিটি সেই খাতায় লেখা আছে। তবে সুযোগ পেলেই তিনি পুরনো রহস্যের মীমাংসা করতে চেষ্টা করেন।
মিসির আলি নিশ্চিত, তিনি মল্লিক সাহেবের রহস্য নিয়ে অনেক দিন ভাববেন। নির্ঘুম রজনী কাটাবেন।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তৃতীয় দিনে মিসির আলির সঙ্গে দেখা করতে এল বক্কা। দুই ভাই সবসময় একসঙ্গে চলাফেলা করে। আজ বক্কা একা।
বক্কা বলল, জসুর কাছে শুনেছি আপনি অসুস্থ। আপনাকে দেখতে এসেছি। আপনার জন্যে চারটা কচি ডাব এনেছি। ডাব বলকারক।
মিসির আলি বললেন, তোমার ভাই কোথায়?
বক্কা বলল, সে কুয়ার মুখ বন্ধ করছে। কুয়ার মুখ বন্ধ থাকা ভালো, তাহলে অ্যাকসিডেন্ট হয় না। আমার মা কুয়াতে ড়ুবে মারা গিয়েছিলেন, এটা কি আপনি জানেন?
জানি।
আমার মা’র নাম সুরমা। এটা জানেন?
জানি।
মা’র মনে অনেক কষ্ট ছিল তো, এইজন্যে তিনি কুয়ায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন। অনেক কষ্ট থাকলে কুয়ায় ঝাঁপ দিতে হয়। ঠিক না চাচাজি?
হ্যাঁ ঠিক। আমি আর ভাইজান কী ঠিক করেছি জানেন? আমাদের মনে যদি অনেক কষ্ট হয় তাহলে কুয়ায় ঝাঁপ দিব। মনের কষ্ট দূর করার জন্যে বাবাকে মারা ঠিক না। বাবা হলো জন্মদাতা পিতা। চাচাজি, ডাব কেটে দিব? খাবেন?
এখন খাব না। পরে খাব।
বক্কা বলল, চাচাজি, এখন কাটি? আপনি ডাবের পানি খাবেন। আমি খাব শাঁস।
মিসির আলি বললেন, ঠিক আছে কাটো। ডাব কাটবে কীভাবে? দা লাগবে তো।
বক্কা বলল, দা নিয়ে এসেছি চাচাজি। দা খারাপ জিনিস। এইজন্যে রুমের বাইরে রেখেছি। ভালো করেছি না। চাচাজি?
হ্যাঁ, ভালো করেছ।
বক্কার ডাব কাটা দেখতে দেখতে মিসির আলি মল্লিক রহস্যের আংশিক সমাধান বের করলেন। এই সমাধানে ডাবের কোনো ভূমিকা নেই। কিছু মীমাংসা হঠাৎ করেই মাথায় আসে। বেশিরভাগ সময় স্বপ্নে আসে। কেকুলে বেনজিনের স্ট্রাকচার স্বপ্নে পেয়েছিলেন। মেন্ডেলিফ পিরিয়ডিক টেবিল স্বপ্নে পান। মিসির আলিও স্বপ্ন দেখছেন–জীবিত মল্লিক এবং মৃত মল্লিক একই। তাদের DNA তা-ই বলছে।
স্বপ্ন অনেককেই ইশারা দিয়েছে। তাকেও দিচ্ছে। কনশাস মস্তিষ্ক হিসাবনিকাশ করে আনকনশাস। মস্তিষ্ককে খবর দিচ্ছে। সেই খবর নিজেকে প্ৰকাশ করছে স্বপ্নে।
স্বপ্নে তিনি লাল টেলিফোন দেখছেন। এই টেলিফোন অবশ্যই তাঁকে ক্লু দিয়ে সাহায্য করবে।
বক্কা আগ্রহ নিয়ে ডাবের শাঁস খাচ্ছে। তৃপ্তিতে তার চোখ প্রায় বন্ধ। মিসির আলি বললেন, তোমাদের বাসার গেষ্টরুমে একটা লাল টেলিফোন আছে না?
বক্কা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
এই টেলিফোনের নম্বর জানো?
বক্কা বলল, এই টেলিফোনের নম্বর শুধু বাবা জানে। আর কেউ জানে না। তোমার বাবা কি ওই ঘরেই থাকেন?
বক্কা বলল, না। মাঝে মাঝে থাকেন। বাকি সময় ওই ঘর তালাবন্ধ থাকে।
তালাবন্ধ থাকে কেন?
ওই ঘরে ভূত থাকে, এইজন্যে তালাবন্ধ থাকে।
কী রকম ভূত?
বক্কা বলল, চাচাজি, কী রকম ভূত আমি জানি না। আমি কখনো দেখি নাই।
কেউ কি দেখেছে? আমার স্ত্রী চম্পা দেখেছে। বড় ভাইজানের স্ত্রীও দেখেছে। চাচাজি, আরও চাইরটা ডাব কিনে নিয়ে আসি?
আর ডাব দিয়ে কী হবে?
বক্কা লজ্জিত গলায় বলল, দুটা মাত্র ডাবে শাঁস হয়েছে। তৃপ্তি করে খেতে পারি নাই।
মিসির আলি বললেন, এখানে ডাব না। এনে তুমি বরং ডাব কিনে বাড়িতে চলে যাও। পুরুষ্ট দেখে কেনো, যাতে ভেতরে শাস থাকে। তারপর দুই ভাই মিলে খাও।