রিং হতে হতে টেলিফোন থেমে গেল। এখন ভাঙচুরের শব্দ হচ্ছে। মিসির আলি বললেন, কী হচ্ছে?
হুড়বুড়ি বলল, স্যার! পুলিশ এসেছে। দরজা ভাঙছে। শব্দ শুনছেন?
মিসির আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, ও আচ্ছা পুলিশ।
পুলিশের সঙ্গে জসু আছে। মনে হয় সে-ই আপনাকে উদ্ধারের জন্যে পুলিশ এনেছে।
স্যার! দরজা ভেঙে ফেলেছে। তাকিয়ে দেখুন, পুলিশ ঢুকছে।
মিসির আলি তাকিয়ে আছেন। তিনি পুলিশ দেখতে পাচ্ছেন। জসুকে দেখতে পাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে মল্লিক সাহেবও আছেন। একজন মৃত মানুষ। যার ডেডবডি কুয়া থেকে তোলা হয়েছে। মৃত মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। এটা নিশ্চয়ই হেলুসিনেশন।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন।
মিসির আলি চোখ মেললেন
স্যার, চোখ মেলুন।
মিসির আলি চোখ মেললেন। তার কাছে মনে হলো তিনি হাসপাতালে আছেন। তাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। একজন অল্পবয়সী ডাক্তার তার সামনে দাঁড়িয়ে। এই ডাক্তার লাল সোয়েটারের ওপর সাদা অ্যাপ্রন পরেছে। তাকে সুন্দর লাগছে।
স্যার, আপনি একটা প্রাইভেট হাসপাতালে আছেন এবং ভালো আছেন। আপনার শরীর খাদ্য গ্রহণের জন্যে এখনো তৈরি না বলে আপনাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। স্যার, আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন?
পারছি।
পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে চান। কথা বলবেন?
হুঁ।
পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব এসে সামনে দাঁড়ালেন। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মিসির আলির এখন মনে হলো, তার হেলুসিনেশন হচ্ছে না। তিনি বাস্তবে বাস করছেন। হেলুসিনেশনের দৃশ্যগুলো চড়া রঙে আঁকা হয়। এখন তা না।
মিসির আলি বললেন, আমি কত দিন বন্দি ছিলাম?
রকিব বললেন, ছয় দিন।
আমি বন্দি-এই খবর আপনাদের কে দিল?
একজন মহিলা টেলিফোনে জানিয়েছেন। তার নাম পারুল।
কবে জানিয়েছে?
যেদিন আপনাকে আটকানো হয় তার পরদিন ভোরবেলা। আমরা তার কথা গুরুত্বের সঙ্গে নেই নি। কারণ এই মহিলা উদ্ভট সব কথা বলছিলেন। তাঁর মৃত শ্বশুর জীবিত হয়ে ফিরে এসেছেন, এইসব হাবিজাবি।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ছে। কথা বলতে বা কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। ঘুমুতে ইচ্ছে করছে।
পুলিশ ইন্সপেক্টর বললেন, স্যার, আপনি রেস্ট নিন। পরে আপনার সঙ্গে আলাপ করব। আপনার কিছু সাহায্যও আমাদের দরকার। মৃত মানুষকে জীবিত দেখার ঘটনা কিন্তু ঘটেছে। একজন দাবি করছেন, তিনি মল্লিক সাহেব। তাঁর কর্মচারীরাও তা-ই বলছে।
মিসির আলি চোখ না মেলেই বললেন, একজন মৃত মানুষ কখনোই জীবিত হয়ে ফিরবে না। এটা মাথায় রাখুন। আমার ধারণা আমি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারব। তবে সুস্থ হওয়ার জন্যে আমাকে কিছুটা সময় দিন।
রকিব বললেন, অবশ্যই স্যার। অবশ্যই।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। চোখ মেললেন তের ঘণ্টা পর। শারীরিক এবং মানসিকভাবে তিনি তখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
মুন হাউস হোটেলে ২১২ নম্বর ঘর। সময় সন্ধ্যা ৭টা।
মল্লিক সাহেব বসে আছেন। মল্লিক সাহেবের মুখ হাসি হাসি। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে তিনি আনন্দময় সময় কাটাচ্ছেন।
কিছুক্ষণ আগে ছোট্ট একটা নাটক হয়েছে। নাটক দেখেও তিনি তৃপ্তির হাসি হোসেছেন।
নাটকটার প্রধান চরিত্র জামু। সে মিসির আলির জন্যে চা নিয়ে এসেছিল। ঘরে ঢুকে মল্লিক সাহেবকে বসে থাকতে দেখে আর্ত চিৎকার দিল-ও আল্লাগো! হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেল। সে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মল্লিক সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, ভয় খাইছে। প্যান্টে পিশাব না করে দেয়।
মিসির আলি বললেন, ভয় পাওয়ারই কথা। সবার কাছে আপনি একজন মৃত মানুষ। আপনার শবদেহ কুয়া থেকে তোলা হয়েছে। তারপর আপনাকে জীবিত দেখা যাচ্ছে। আপনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সিগারেট খাচ্ছেন।
মল্লিক দাঁত বের করে তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, পুরা ঘেংড়া অবস্থা!
মিসির আলি বললেন, ঘেংড়া অবস্থা মানে কী?
অতিরিক্ত বেড়াছেড়াকে বলে ঘেংড়া অবস্থা। পাবলিক তো ভয় খাবেই। পাবলিকের ভয় খাওয়ারই কথা। পুলিশও ভয় খাচ্ছে। ঘটনা শোনেন, মজা পাবেন। আমি পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব সাহেবের সঙ্গে হাত মিলাবার জন্যে হাত বাড়ালাম, উনি লাফ দিয়ে দুই ফুট সরে গেলেন। একমাত্র আপনাকে দেখলাম ভয় খান নাই। আপনাকে দেখে কিছুটা আচানক হয়েছি। আপনি কেন ভয় খান নাই?
মিসির আলি বললেন, আমি জানি মৃত মানুষ কখনো জীবিত হয়ে ফেরে না। অন্য কোনো ব্যাপার আছে। এইজন্যে ভয় পাই নি।
মল্লিক সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, অন্য ব্যাপারটা কী? আমারে একটু বুঝায়ে বলেন।
মিসির আলি বললেন, আপনার যমজ ভাই আছে, যে দেখতে অবিকল আপনার মতো। সে মারা গেছে অথবা খুন হয়েছে। তার ডেডবডি কুয়ায় ফেলা হয়েছে। আপনার না।
কেউ জানল না-এটা কেমন কথা!
মিসির আলি বললেন, কেউ জানে না তা ঠিক না। আপনার দুই ছেলে তো প্রায়ই বলত, এরা দু’জন মল্লিককে দেখে। একজন ভালো। একজন মন্দ।
পাগলের কথা। আপনি ধরবেন? দুটাই পাগল। নির্বোধ পাগল। প্রায়ই দেখবেন। এরা কানে ধরে উঠবোস করছে। কেউ তাদের কানে ধরে উঠবোস করতে বলে নাই। তারপরেও করছে। বলুন তো কেন?
মিসির আলি বললেন, জানি না কেন?
অনুমান করতে পারেন?
না। অনুমানও করতে পারছি না।
মল্লিক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এই দুই ছাগলকে আমি প্রায়ই এক শ বার পঞ্চাশ বার কানে ধরে উঠবোস করতে বলি। এরা অ্যাডভান্স করে রাখে। খাতায় লেখা থাকে। সেখান থেকে বাদ দেয়। এদের কোনো কথার উপর বিশ্বাস রাখা যায়? আপনি বলেন? পাগলের সাক্ষী কি কোর্ট গ্রাহ্য করবে? চুপ করে থাকবেন না। কথা বলেন।