বাথরুম থেকে শব্দ আসছে। মনে হচ্ছে কেউ থালাবাসন ধুচ্ছে।
মিসির আলি বললেন, কে?
কিশোরীদের মিষ্টি গলায় কেউ একজন বলল, চাচাজি! আমি চম্পা।
মিসির আলি হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, আবার হেলুসিনেশন শুরু হয়েছে।
মিসির আলি বললেন, বাথরুমে কেন? সামনে আসো।
চাচাজি! আমি বাথরুম পরিষ্কার করছি। আমার হাতে হাতমোজা নেই বলে আপনার সামনে আসতে পারব না। আপনার সামনে এলে আপনি আমার হাত দেখে ফেলবেন। আমার বিরাট পাপ হবে। শেষ বিচারের দিন জবাব দিতে পারব না।
মিসির আলি বললেন, ও আচ্ছা।
চম্পা বলল, শরীরের উপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে তো চাচাজি। কাউকেই এখন শরীর দেখাই না। হাত পায়ের আঙুল, চোখ, সব লুকিয়ে রাখি। চাচাজি! এই ঘরটা কি চিনতে পারছেন?
না।
আপনার এত বুদ্ধি, আর সাধারণ ব্যাপারটা ধরতে পারলেন না। ঘরে একটা মাত্র জানালা। সেই জানোলা কঠিনভাবে বন্ধ।
মিসির আলি বললেন, এই ঘরেই কি তুমি তোমার শ্বশুর সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আসো?
চম্পা বলল, আপনি খুব সুন্দর করে বললেন, দেখা করতে আসি। আমি দেখা করতে আসি না। বাধ্য হয়ে ভয়ংকর কিছু কর্মকাণ্ডের জন্যে আসি।
মিসির আলি বললেন, তুমি আমাকে আটকে রেখেছ কেন?
চম্পা বলল, আমি আপনাকে আটকে রাখি নি। বড়পা রেখেছে।
কেন?
বড়পা এই ঘরে অনেক দিন আটক ছিল। এই দুঃখে সে সবাইকেই এভাবে আটকে রাখতে চায়।
কত দিন আটকে রাখবে?
জানি না। মনে হয় ছাড়বে না।
ছাড়বে না?
না। চাবি কুয়ায় ফেলে দিয়েছে তো। দরজা খুলবে কীভাবে?
সেটাও একটা কথা।
চাচাজি! আমি এখন যাই। পরে আসব। হাতমোজা পরে আসব, তখন আপনার সামনে আসা যাবে। গল্প করা যাবে।
আচ্ছা।
আপনার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসব। আপনি আরাম করে সিগারেট খাবেন।
শেষ হয়ে গেছে।
চম্পা বলল, অবশ্যই দিয়াশলাই আনব। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন তো চাচাজি। আপনার ঘুম দরকার। ঘুমপাড়ানি গান গাইয়ে ঘুম পাড়াব?
মিসির আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, গান লাগবে না। এমনিতেই ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
মিসির আলি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।
একসময় ঘুম ভাঙল। তিনি অবাক হয়ে দেখেন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি পড়ছে ঘরের ভেতর। কাক-দম্পতির বাসও ঘরের ভেতর। বৃষ্টিতে ভিজে দুটা কাক শীতে থারথার করে কাঁপছে। পুরুষ কাকটা মিসির আলিকে বলল, স্যার, একটা ছাতা দিতে পারবেন? প্লিজ!
মিসির আলি বললেন, ছাতা পাব কোথায়? তাকিয়ে দেখো, আমিও ভিজছি।
কাক বলল, একটা কিছু ব্যবস্থা কি করা যায় স্যার? বৃষ্টির পানি ভয়ংকর ঠান্ডা। ডিমগুলো পুরোপুরি ভিজে গেলে আর বাচ্চা ফুটবে না।
মিসির আলি বললেন, তোমার বাসাটা কি আমার খাটের নিচে আনতে পারো? তাহলে বৃষ্টির পানির হাত থেকে বাঁচতে পারো।
থ্যাংক য়্যু স্যার। ভালো সাজেশন।
কাকা-দম্পতি অনেক কষ্টে বাসাটা খাটের দিকে আনছে। বাসা মিসির আলির হাতের নাগালে চলে এসেছে। তিনি ইচ্ছা করলেই হাত বাড়িয়ে বাসাটা ধরে খাটের নিচে চালান করে দিতে পারেন, কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর সমস্ত শরীর অবশ। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মিসির আলির কেন জানি মনে হচ্ছে এবার ঘুমিয়ে পড়লে আর ঘুম ভাঙবে না। তিনি প্ৰাণপণে জেগে থাকার চেষ্টা করছেন।
স্যার স্নামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? আমি আপনার ছাত্রী। আমার নাম রেবেকা।
ও আচ্ছা আচ্ছা।
চিনতে পারেন নি?
শরীরটা ভালো না তো। এইজন্যে সমস্যা হচ্ছে।
স্যার, আমি আপনাকে চামড়ায় বাধানো একটা খাতা দিয়েছিলাম।
এখন মনে পড়েছে। তুমি কেমন আছ?
আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনার একী অবস্থা!
একটু বেকায়দা অবস্থাতেই আছি। এরা আমাকে আটকে ফেলেছে।
কেন?
কেন তা তো জানি না।
স্যার, আপনি জানবেন না তো কে জানবে? আপনি হচ্ছেন মিসির আলি। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে বের করুন কেন তারা আপনাকে আটকেছে। এরা কি আপনার শত্রুপক্ষ?
না।
তাদের ক্ষতি হয় এমন কিছু কি আপনি করেছেন?
না।
আপনাকে আটকে রাখলে তাদের কি কোনো স্বার্থসিদ্ধি হয়?
না!
আপনার চিন্তা করার ক্ষমতা ঠিক আছে কি না, সেই পরীক্ষা কি করবেন?
কী পরীক্ষা?
ক্লিৎস টেস্ট। স্যার, মনে পড়েছে?
হ্যাঁ, পড়েছে। ১০০ থেকে নিচের দিকে নামতে হবে।
প্রথমবার একটি সংখ্যা বাদ দিয়ে নিচে নামা।। ১০০ থেকে হবে ৯৮, তারপর দুটা সংখ্যা বাদ ৯৫, তারপর তিন সংখ্যা বাদ ৯১।
স্যার, পরীক্ষা দিতে থাকুন। এই ফাঁকে আমি পানি এনে দিচ্ছি। পানি খান।
পানি কোথায় পাবে? পানি তো বন্ধ।
আমি কমোড থেকে পানি আনব। আপনি কল্পনা করবেন ঝরনার পবিত্ৰ পানি খাচ্ছেন। বেঁচে থাকার জন্যে আপনার পানি খাওয়াটা জরুরি। ঠিক না। স্যার?
হ্যাঁ ঠিক।
মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। তিনি কতক্ষণ ঘুমালেন তা জানেন না। পানির পিপাসায় তাঁর বুক শুকিয়ে গেছে। বিছানা থেকে নামার শারীরিক শক্তি তাঁর নেই।
মাথার কাছে দুঃখিত চোখমুখ করে পারুল দাঁড়িয়ে আছে।
মিসির আলি বললেন, পারুল। আমাকে একগ্লাস পানি খাওয়াতে পারবে?
আমি পারুল না। আমি এক ভূতনি। আমার নাম-হুড়বুড়ি।
ও আচ্ছা, তুমি হুড়বুড়ি?
জি হুড়বুড়ি। একটা ছড়া শুনবেন স্যার।
হুড়বুড়ি, থুরথুরি
বুড়বুড়ি, কুরকুরি
ফুরফুরি, ফুরফুরি
মিসির আলি বললেন, চুপ করো প্লিজ।
হুড়বুড়ি চুপ করল। তখন বেজে উঠল। লাল টেলিফোন। এই টেলিফোনের তার ছেড়া, তারপরেও বাজছে কেন? টেলিফোন নিশ্চয়ই বাজছে না। তিনি ভুল শুনছেন। তার বিভ্ৰান্তির কাল শুরু হয়েছে।