মিসির আলি টাইম পত্রিকা, রিডার্স ডাইজেস্ট এবং নেয়ামুল কোরান গ্রন্থের সবটা পড়ে শেষ করেছেন। নেয়ামুল কোরান পড়তে গিয়ে মিসির আলি বুঝতে পারলেন এই ঘরে আরও একজনকে আটকে রাখা হয়েছিল। সে নেয়ামুল কোরান গ্রন্থের অনেক জায়গায় যেসব কথা লিখেছে তা হলো—
১. আমাকে কত দিন তালাবন্ধ করে রাখবি?
২. ক্ষুধায় মরে যাচ্ছি, খাওয়া দে।
৩. আমি তোরে ছাড়ব না। তোরে এইভাবে আটকায়ে রাখব।
৪. হে আল্লাহপাক। হে গাফুরুর রহিম। আমাকে উদ্ধার করো।
যাকে আটকে রাখা হয়েছিল তার নাম পারুল। এই তথ্য বের করতে মিসির আলির তেমন বেগ পেতে হয় নি। বালিশে পারফিউমের গন্ধ পেয়েছেন। এই গন্ধ তার চেনা।
প্রাইভেট জেলখানা থেকে মুক্তির একটা বুদ্ধি মাথায় এসেছে। এই বুদ্ধি কতটা কার্যকর হবে তা মিসির আলি এখনো বুঝতে পারছেন না।
মূল দরজাটি কাঠের। এই দরজা কি আগুন দিয়ে জ্বলিয়ে দেওয়া যাবে? পুরনো দরজা, শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে আছে। কোনোরকমে দরজার এক কোনায় আগুন লাগালে দরজা পুড়ে যাবে।
আগুন লাগানোর জন্যে ম্যাচ বাক্স তার কাছে আছে। ম্যাচ বাক্সে এগারটা কাঠি। এগারবার জ্বালানো যাবে। কাগজ আছে। ধৈর্য ধরে দরজার একটা কোনায় আগুন ধরাতে হবে। কাজটা করতে হবে ভোেররাতে। যখন সবাই থাকবে ঘুমে। দরজার আগুন বা ধোয়ার বিষয়টা কারও চোখে পড়বে না। বাথরুমে তিনি শ্যাম্পূর একটি বোতল দেখেছেন। কিছু কিছু শ্যাম্পু যথেষ্ট দাহ্য। শ্যাম্পূর বোতলটা নিয়ে পরীক্ষা করা যেতে পারে।
খাটের নিচে তিনি একটা ফিডার পেয়েছেন। প্লাষ্টিকের ফিডারে আগুন ধরলে ধিকি ধিক করে অনেকক্ষণ জুলবে। কাঠের দরজার এক কোনায় আগুন ধরে যাওয়ার কথা। দরজায় চাকু দিয়ে দাগ দিতে পারলে হতো। এতে দরজার সারফেস এরিয়া বাড়বে।
রাত তিনটায় মিসির আলি দরজা পোড়ানোর সময় নির্ধারণ করলেন। রাত তিনটা ভালো সময়। তিন প্রাইম নম্বর। পিথাগোরাসের মতে, অতি রহস্যময় সংখ্যা।
দরজা পুড়িয়ে বের হওয়ার বুদ্ধি
দরজা পুড়িয়ে বের হওয়ার বুদ্ধি কাজ করল না। দরজার এক কোনায় আগুন ঠিকই জ্বলল, তবে সে আগুন স্থায়ী হলো না। দরজার খানিকটা পুড়িয়ে নিভে গেল। লাভের মধ্যে লাভ এই হলো যে, দরজা পোড়ানোর উত্তেজনায় মিসির আলির রাত কাটল নির্ঘুম। শরীরে ধস নেমে গেল।
বেঁচে থাকার জন্যে শরীরকে মোটামুটি ঠিক রাখতে হবে। প্রচুর পানি খেতে হবে। তা তিনি খাচ্ছেন। বাথরুমের বেসিন থেকে নিয়ে মগভর্তি পানি। কিছুক্ষণ পরপর পানি। তার মন বলছে বাথরুমের বেসিনের পানি থাকবে না। যে তাকে আটকেছে সে পানি বন্ধ করে দেবে। তখন প্রবল তৃষ্ণায় কমোডের পানি ছাড়া গতি থাকবে না।
ক্ষুধার যন্ত্রণা কমে আসছে। কাজটি করছে মস্তিষ্ক। মস্তিষ্ক যখন দেখে খাবার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই তখন ক্ষিধে কমিয়ে দেয়। শরীরে জমে থাকা চর্বি থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। একজন সবল মানুষ কোনো খাদ্য গ্ৰহণ না করে চল্লিশ দিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে।
মিসির আলি কোনো সবল মানুষ না। নানান অসুখে পর্যাদস্ত একজন মানুষ। তিনি ধরে নিয়েছেন, এইভাবে তিনি বেঁচে থাকতে পারবেন। দশ দিন। এর বেশি না। তবে শেষ দিনগুলো খুব কষ্টকর হবে না। তার হেলুসিনেশন শুরু হবে। বাস্তবতার দেয়াল ভেঙে যাবে। তিনি ঢুকে পড়বেন অবাস্তব এক জগতে। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে অনেকবার সেই জগতে তার ঢোকার ইচ্ছে হয়েছে। ইচ্ছে এখন পূর্ণ হতে চলছে, কিন্তু তার ভালো লাগছে না।
বন্দি অবস্থায় মিসির আলি আটান্ন ঘণ্টা পার করলেন। ক্ষুধাবোধ এখন পুরোপুরি চলে গেছে। তৃষ্ণা আছে, তবে তা কম। বেসিনের কলের পানি বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি শেষ পানি কখন খেয়েছেন তা মনে করতে পারছেন না। প্ৰবল ক্লান্তি তাকে ভর করেছে। সময় কাটাচ্ছেন বিছানায় শুয়ে। হেলুসিনেশন শুরু হয়েছে। শুরুটা হলো ঘড়ি দিয়ে। মিসির আলি হঠাৎ দেখলেন ঘড়ির কাটা উল্টোদিকে ঘুরছে।
মিসির আলি মনে মনে বললেন, ইন্টারেস্টিং। হাতে কাগজ-কলম থাকলে হেলুসিনেশনের ধাপগুলো লিখে ফেলতে পারতেন। হাতে কাগজ-কলম নেই।
ঠিক তিনটা বাজার সময় ঘড়ি উল্টোদিকে চলা শুরু করেছিল। এখন বাজছে দুটা। ঘড়ির কাটা কি দ্রুত ঘুরছে? তিনি বুঝতে পারলেন না।
মিসির আলি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙলে দেখেন, তিনি বাইনোকুলার হাতে হোটেলের বারান্দায় বসে আছেন। কাক-দম্পতি দেখছেন। তিনি কি সত্যি হোটেলের বারান্দায়? নাকি এটিও হেলুসিনেশন? যখন কাক মানুষের মতো কথা বলতে শুরু করল তখন বুঝলেন এটা হেলুসিনেশন।
কাক বলল, মানুষের যেমন প্রাইভেসি আছে, আমাদেরও আছে। আপনি সারাক্ষণ বাইনোকুলার ফিট করে রাখছেন, এটা কি ঠিক? আপনার ওপর কেউ বাইনোকুলার ফিট করে রাখলে আপনার ভালো লাগত?
মিসির আলি বললেন, না।
কাক বলল, সবারই অনেক প্রাইভেট ব্যাপার আছে। হাগা-মুতা আছে। ঠিক কি না। স্যার আপনি বলেন?
মিসির আলি বললেন, অবশ্যই ঠিক। আমি দুঃখিত। আর বাইনোকুলার ধরব না।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লেন। কতক্ষণ ঘুমালেন তিনি জানেন না। হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম ভাঙল অথবা দীর্ঘ সময় ঘুমালেন। ঘুম ভাঙলে প্রথমেই ঘড়ি দেখলেন। ঘড়ি উল্টাদিকে যাচ্ছে না। স্থির হয়ে আছে। ঘড়ির হিসাবে সময় এখন বারোটা। দিন বা রাত বোঝা যাচ্ছে না।