রাত ন’টার দিকে হোটেলের মালিক নিজেই টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে এলেন।
গরম ভাত
মুগের ডাল
পটল ভাজি
কৈ মাছের ঝোল।
কবীর সাহেব বললেন, আয়োজন খারাপ, কিন্তু খেয়ে আনন্দ পাবেন। বাবুর্চির রান্না খুবই ভালো। সে যদি কাঁঠাল পাতার ঝোল রাধে, সেই ঝোল খেয়েও বলবেন, অসাধারণ! এই বাবুর্চি আবার ভালো পা দাবাতে পারে। আপনার যে বয়স তাতে পা দাবালে শরীর ভালো থাকবে। তাকে বলে দেব সে প্রতি রাতে এসে কিছুক্ষণ আপনার পা দাবাবে।
মিসির আলি বললেন, আমার পা দাবাতে হবে না। শারীরিক এই আরাম আমি নেব না। আপনি আমার প্রতি যে বাড়তি মমতা দেখাচ্ছেন, তার কারণটা কী বলবেন?
কবীর সাহেব বললেন, বাড়তি মমতা দেখাচ্ছি না।
হোটেলের সব বোর্ডারের জন্যে আপনি নিশ্চয়ই খাবারের ব্যবস্থা করেন না, বা নিজে তার জন্যে টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার আনেন না।
কবীর সাহেব বললেন, আপনার চেহারা, কথা বলার ভঙ্গি, হাঁটা সবই আমার বাবার মতো। আমি আপনাকে দেখে চমকে উঠেছিলাম।
আপনার বাবা কবে মারা গেছেন?
আমার বয়স যখন পাঁচ তখন।
মিসির আলি বললেন, পাঁচ বছর বয়সের কথা পরে মনে থাকে না। আপনার বাবার বিষয়ের খুব কম স্মৃতিই আপনার আছে। এই কারণেই অনেকের সঙ্গে আপনি আপনার বাবার চেহারার মিল পাবেন। আমার আগেও নিশ্চয়ই অনেকের সঙ্গে আপনি আপনার বাবার চেহারার মিল পেয়েছেন। তাই না?
জি।
মিসির আলি রাতের খাবার খেয়ে সত্যি সত্যি আনন্দ পেলেন। পটল ভজিকে তিনি এত দিন। অখাদ্যের পর্যায়ে রেখেছিলেন। আজ মনে হলো এই ভাজি খাদ্যতালিকায় রোজ থাকতে পারে।
খাওয়া শেষ হওয়ার পর কবীর সাহেব বললেন, পান খাওয়ার অভ্যাস কি আছে?
মিসির আলি বললেন, নাই। তবে আজ একটা পান খাব। তৃপ্তি করে খাবার খেলে কেন জানি না জর্দা দিয়ে পান খেতে ইচ্ছা করে।
পান ছাড়া আর কিছু কি লাগবে?
একটা বাইনোকুলার কি জোগাড় করে দিতে পারবেন?
বাইনোকুলার দিয়ে কী করবেন?
কাঁঠালগাছে একটা কাক বাসা বেঁধেছে। ডিম পেড়েছে। ডিমে তা দিচ্ছে। ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার দৃশ্যটা দেখব।
কবীর সাহেব বললেন, পান এনে দিচ্ছি। সকালবেলা বাইনোকুলার এনে দেব। চলবে না?
অবশ্যই চলবে। থ্যাংক য়্যু।
কবীর সাহেব হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন। তার হাসি দেখে মিসির আলির ভালো লাগল।
হোটেল জসুর খুবই পছন্দ হয়েছে। হোটেলের সব কর্মচারী বড় একটা ঘরে থাকে। জসুর ব্যবস্থা হয়েছে সেখানে। বিনিময়ে বাবুর্চির ফুটফরমাশ খাটবে। জসুর মাথায় ঢুকেছে সে বাবুর্চি হবে। সে স্বপ্নে দেখেছে, বিশাল এক রেস্টুরেন্টের ক্যাশবাক্সে সে বসেছে। রেস্টুরেন্টের নাম ‘জসুর মোরগপোলাও’।
রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে জসু মিসির আলির খোঁজ নিতে এল। মিসির আলি বললেন, জসু, তোমার বিষয়টা নিয়ে আমি এখন চিন্তাভাবনা শুরু করব।
জসু অবাক হয়ে বলল, আমার কোন বিষয়?
মিসির আলি বললেন, এক ভূতনি এসে তোমার পা চাটে ওই বিষয়। ভূতনিটার বয়স কত?
জসু বলল, তার বয়স কত ক্যামনে বলব? আমি তো তারে বয়স জিগাই নাই।
তাকে তো দেখেছ?
জি দেখছি।
দেখে বয়স কী রকম মনে হয়?
পারুল আপার বয়সী মনে হয়। চেহারাও উনার মতো। খুবই সৌন্দর্য।
মিসির আলি বললেন, পারুল আপা হলো ছক্কার স্ত্রী?
জি। এমন সুন্দর উনার চেহারা। দেখলে আপনি ফিট পড়বেন। রাইতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে।
মিসির আলি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। জসুর ভূতনি ফ্রয়েডিয়, এটা বোঝা যাচ্ছে। তবে ফ্রয়েডিয় ভূতানির সঙ্গে ‘হুড়বুড়ি’ নাম যাচ্ছে না।
ঘরের সামনে এক চিলতে বারান্দা
২১২ বি ঘরের সামনে এক চিলতে বারান্দার মতো আছে। সেখানে কবীর সাহেব চাপাচাপি করে দুটা লাল লঙের প্লাস্টিকের চেয়ার এবং টেবিল ঢুকিয়েছেন।
নিয়ে দেখছেন। মিসির আলির ধারণা কাক-দম্পতিও বিষয়টা টের পেয়েছে। মনুষ্য সম্প্রদায়ের কেউ-একজন তাদের প্রতি লক্ষ রাখছে, এটা তারা জানে। বিষয়টাতে কাক-দম্পতি মনে হয় খানিকটা চিন্তিত।
দুপুর বারোটার মতো বাজে। জসু কিছুক্ষণ আগে প্লেটে করে সিঙারা দিয়ে গেছে। গরম সিঙারা, ভাপ উঠছে, কিন্তু কেন জানি মিসির আলির খেতে ইচ্ছা করছে না। এটাও বয়স হওয়ার লক্ষণ। ক্ষিধে হবে, কিন্তু খেতে ইচ্ছা করবে না।
মিসির আলি হঠাৎ লক্ষ করলেন, বিদেশিনী এক তরুণী হোটেলের বারান্দায় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটির পরনে ঘাগড়া জাতীয় পোশাক। মাথায় স্কাফ। চোখে রোদ চশমা। মেয়েটি এগিয়ে আসছে মিসির আলির দিকে। মিসির আলি বাইনোকুলার নামিয়ে তরুণীর দিকে তাকালেন। তরুণী বলল, চাচাজি, কেমন আছেন? আমার নাম পারুল। চম্পার বড় বোন পারুল। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যে এসেছি। আমি কি আপনার সামনের চেয়ারটায় বসতে পারি?
চম্পা-পারুলদের কেউ হোটেল খুঁজে বের করে চলে আসবে, এটা মিসির আলি ভাবেন নি। পারুল মেয়েটা যে এত রূপবতী তাও ভাবেন নি। বিস্ময় চাপা দিয়ে মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, বসতে পারো। বোরকা নেই, ব্যাপার কী?
আমি তো কখনো বোরকা পরি না। আমার ছোটবোন পরে।
তোমার ছোটবোন কি তোমার মতোই রূপবতী?
জি। আমরা যমজ বোন। তবে আমার চোখ নীল, ওর চোখ কালো।
পারুল বসতে বসতে বলল, চাচাজি, আমি দূর থেকে দেখেছি আপনি বাইনোকুলার চোখে দিয়ে গাছের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী দেখছিলেন?
কাক দেখছিলাম।
কাক?
হ্যাঁ কাক। কেন কাক দেখছিলাম, এইসব জিজ্ঞেস করে সময় নষ্ট করবে না। আমার কাছে কী জন্যে এসেছে সেটা বলে।