তিনি বড় বোন পারুলের অপেক্ষা করতে করতে সিগারেট ধরালেন। নিকোটিনের জট আলগা করার ক্ষমতা আছে। এই মুহুর্তে নিকোটিনের ধোঁয়া তার ওপর কাজ করছে না। জটি আলগা হচ্ছে না, বরং আরও পেঁচিয়ে যাচ্ছে।
পারুল এসেছে। ঠিক ছোটবোন চম্পার মতো বোরকা, মোজা, বোরকার রঙ কালো। পা এবং হাতের মোজার রঙও কালো। ছোটবোনের গা এবং বোরকা থেকে কোনো পারফিউমের গন্ধ আসে নি। বড়বোনের বোরকা থেকে হালকা পারফিউমের গন্ধ আসছে। লেবু ও চা-পাতার মিশ্র গন্ধের পারফিউম। ছোটবোনের গলা ঝনঝন করছিল। বড়বোনের গলা চাপা, কিছুটা খসখসে।
মিসির আলি বললেন, তোমার ছোটবোন আমাকে ভয়ংকর কিছু কথা শুনিয়েছে।
পারুল বলল, ভয়ংকর হলেও কথা সত্য। আপনার সঙ্গে যদি কোরান মজিদ থাকে, আমার হাতে দেন। আমি কোরান মজিদ মাথায় নিয়া বলব, ঘটনা সত্য।
তোমরা কি নিয়মিত নামাজ রোজা করো?
জি করি। আমরা দুই বোনই অনেক রাত জেগে ইবাদত বন্দেগি করি। তবে ইবাদত বন্দেগি শ্বশুরের আড়ালে করতে হয়। উনি পছন্দ করেন না। রাত তিনটা থেকে ফজরের ওয়াক্ত পর্যন্ত আমরা নামাজ পড়ি। রাত তিনটায় ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখি।
মিসির আলির কাছে দুটা বিষয় স্পষ্ট হলো। রাত তিনটায় তাঁর নিজের ঘুম ভাঙার রহস্য তার একটি। চম্পা-পারুল এই দুই বোন স্কিজোফ্ৰেনিয়ার রোগী, তাও এখন স্পষ্ট। এই ধরনের রোগীদের প্রধান লক্ষণ হলো ধৰ্মকর্মে চূড়ান্ত আসক্তি।
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, শ্বশুরের সঙ্গে রাত্রি যাপনের কথাটাও কি সত্যি?
জি চাচাজি। তবে আমি কখনো উনার কাছে যাই নি। চম্পা গিয়েছে। কখনো চম্পা হিসেবে গেছে, কখনো পারুল হিসেবে। চম্পার গর্ভে উনার একটি ছেলেও হয়েছিল। নাম কিসমত। এই ছেলেটিই নিউমোনিয়ায় মারা গেছে।
মিসির আলি বললেন, আমি শুনেছিলাম ছেলেটি তোমার।
পারুল বলল, আমার কোনো ছেলেপুলে নাই। আমি নিঃসন্তান। চম্পার দু’বার যমজ সন্তান হয়েছে। একবার হলো এক সন্তান। কিসমত।
মিসির আলি বললেন, নিউমোনিয়ার চিকিৎসা কি হয়েছিল?
আসল চিকিৎসা হয় নাই। ছেলের বাপ অৰ্থাৎ আমার শ্বশুর সাহেব হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেছেন। তার নিউমোনিয়া কীভাবে হয়েছিল জানতে চান?
বলো শুনি।
পারুল বলল, আমি আর চম্পা এই দুজনে শলাপরামর্শ করে কিসমতকে ছাদে খালি গায়ে দুই ঘণ্টা শুইয়ে রেখেছি, এতেই কাজ হয়েছে। পাপ বিদায়।
পারুল খিলখিল করে অনেকক্ষণ হাসল। তার হাসি থামার পর মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, তুমি পারুল না, তুমি চম্পা! পারুল সেজে দ্বিতীয়বার আমার কাছে এসেছ। গলা চেপে কথা বলছি। মাঝে মাঝে চেপে কথা বলার ব্যাপারটা ভুলে যাচ্ছ বলে মূল স্বর চলে আসছে। চম্পা! তুমি আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছ। কেন করছ জানি না। জানতে চাচ্ছি না। তুমি এখন বিদায় হও। তোমার আর কোনো গল্প শুনতে আমি রাজি না। আমার ধারণা, তোমরা দুই বোনই অসুস্থ। স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগী। তোমাদের কোনো কথাই বিশ্বাসযোগ্য না।
চাচাজি, পারুল আপা কখনো কোথাও যায় না। কারও সঙ্গে কথাও বলে না। এই জন্যে বাধ্য হয়ে পারুল সেজে এসেছি। আপনি দয়া করে আমাদের একটু সাহায্য করুন।
মিসির আলি বললেন, আমার সাহায্যের তোমার প্রয়োজন নেই। আমাকে যা বলেছ পুলিশকে তা-ই বলবে। পুলিশ তদন্ত করে বের করবে। ঘটনা কী?
চাচাজি! আমি এখন আপনাকে একটা জরুরি কথা বলব।
মিসির আলি বললেন, আমি তোমার কোনো কথাই শুনব না।
তাহলে কিন্তু ছোট্ট একটা সমস্যা হবে।
বলো কী সমস্যা?
আপনি ভাড়াটে হিসেবে এখানে আর থাকতে পারবেন না। এখন সবকিছু চালাচ্ছে আমার বড়বোন পারুল।
মিসির আলি বললেন, সমস্যা নেই, আমি বাড়ি ছেড়ে দিব।
আজকেই ছাড়তে হবে। মিসির আলি হেসে ফেলে বললেন, পুরো মাসের ভাড়া আমার দেওয়া, তারপরেও আজ রাতেই বাড়ি ছেড়ে দেব।
মিসির আলির মনে হলো তিনি অতি বৃদ্ধ মানুষের মতো আচরণ করছেন। অতি বৃদ্ধরা অকারণে অভিমান করে। তিনিও তা-ই করছেন। চম্পা মেয়েটির ওপর অভিমান ঘটিত রাগ করেছেন। চট করে কারও ওপর রেগে যাওয়া তার স্বভাবেই ছিল না। এ রকম কেন হচ্ছে?
আজকের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে হলে নতুন বাসা খুঁজে বের করতে হবে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা শহরে বাড়ি খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
মিসির আলি অনেক খুঁজে পেতে মালিবাগের এক হোটেলে এসে উঠলেন। হোটেলের নাম ‘মুন হাউস’। হোটেলের মালিক কবীর সাহেবকে মিসির আলির কাছে যথেষ্টই ভদ্রলোক বলে মনে হলো। তিনি মিসির আলির বিছানা, বালিশ, সিঙ্গেল খাট, চেয়ার-টেবিল গুদামঘরে রাখার ব্যবস্থা করলেন। মিসির আলির বারো ইঞ্চি কালার টিভি তার ঘরেই লাগানোর ব্যবস্থা করলেন।
মুন হাউসে খাবারের ব্যবস্থা নেই। হোটেলের বয় টিফিন ক্যারিয়ারে করে বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসে। কবীর সাহেব মিসির আলিকে এই ঝামেলা থেকেও মুক্তি দিলেন। হোটেলের কর্মচারীদের জন্যে যে খাবার তৈরি হয়, তার সঙ্গে মিসির আলি এবং জসুও যুক্ত হয়ে গেল।
হোটেলে মিসির আলির রুম নম্বর ২১১ বি। ২১১-র দুটা ঘর আছে। একটা ২১১ এ, আরেকটা ২১১ বি। এ-বি দিয়ে রুম নম্বর দেওয়ার ব্যাপারটি তিনি বুঝতে পারলেন না। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। আমাদের এই জগৎ কার্যকারণের জগৎ। কাৰ্যকারণ ছাড়া এখানে কিছুই হয় না। প্রথমে Cause, তারপর effect। মিসির আলির ঘরটা বেশ বড়। ঘরে দুটা জানোলা। একটা পশ্চিমে আরেকটা পুবে। পশ্চিমের জানোলা খুললে প্ৰকাণ্ড এক কাঁঠালগাছ দেখা যায়। কাঁঠালগাছে কাক বাসা বেঁধেছে। জানালা দিয়ে তাকালে কাকের বাসায় চারটা ডিম দেখা যায়। কোকিলরা সন্তান বড় করার ঝামেলা এড়ানোর জন্যে কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। এখানে কি কোনো কোকিলের ডিম আছে? মিসির আলি ঠিক করলেন, ডিম থেকে ছানা বের না হওয়া পর্যন্ত তিনি এই হোটেলেই থাকবেন। নতুন বাসা খুঁজে বেড়াবেন না।