চাচাজি আসব?
মিসির আলি চমকে তাকালেন। দুই ভাই মুখ কাচুমাচু করে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে বাচ্চাটি নেই। মিসির আলি বই বন্ধ করে বললেন, এসো।
দুই ভাই ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে ছিটিকিনি লাগিয়ে দিল।
চাচাজি, আপনার ঘরে একটু বসি?
বসো। কোনো সমস্যা নেই। চা খাবে?
জি-না।
সকালের নাশতা করেছ?
জি। বিরিয়ানি খেয়েছি। কথা বলছে বড়ভাই। ছোটভাই ঠোঁট নাড়াচ্ছে। এইবার ছোটভাই কথা শুরু
করল, বড়জন চুপ।।
বাবা এক শ বার কানে ধরে উঠবোস করতে বলেছিলেন, আমরা এক শ দশ
বার করেছি। দশটা ফ্রি করে দিয়েছি। ভালো করেছি না। চাচাজি?
অবশ্যই ভালো করেছি। শাস্তিটা হয়েছে কী জন্য? অপরাধ কী করেছিলে?
উনার দিকে তাকিয়ে হেসেছি।
হেসে ফেলার জন্য শাস্তি?
খারাপ হাসি হেসেছি চাচাজি।
হাসির ভালো-খারাপ আছে?
জি আছে।
মিসির আলি বললেন, আমার দিকে তাকিয়ে একটা খারাপ হাসি দাও তো। দেখি ব্যাপারটা কী?
দুই ভাই চুপ করে আছে। মনে হয় তাদের পক্ষে খারাপ হাসি দেওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব না।
ছোটভাই বলল, চাচাজি, আপনি কি অন্য ঘরে যাবেন? আমরা এখন বেয়াদবি করব।
কী বেয়াদবি করবে?
সিগারেট খাব ৷
আমার সামনে খাও। অসুবিধা নেই।
চাচাজি, মন থেকে অনুমতি দিয়েছেন?
হ্যাঁ।
আপনার মতো মানুষ ত্ৰিভুবনে কম আছে।
বলতে বলতে বড়ভাই শার্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করল। একটা সিগারেটই দু’জনে মিলে টানছে। কুৎসিত গন্ধে ঘর ভর্তি হয়ে গেছে। তারা যে সিগারেট টানছে তা সাধারণ সিগারেট না। গাঁজাভর্তি সিগারেট।
মিসির আলির মনে হলো রহস্যের একটা জটি খুলেছে। গাজা ডিলিউশনের দরজা খুলে দেয়। এইজন্যেই লোকগানে বলা হয়-‘গাঁজার নৌকা শূন্যের ভরে যায়।’
বক্কা বিনীত গলায় বলল, চাচাজি কি একটা টান দিবেন?
মিসির আলি বললেন, না। তোমরা কি নিয়মিত খাও?
দুই ভাই একসঙ্গে বলল, জি-না। আজ একটা বিশেষ দিন।
বিশেষ দিন কী জন্যে?
দুই ভাইয়ের কেউই জবাব দিল না। বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল।
তার মিনিট দশোকের, মাথায় জিপভর্তি করে পুলিশের গাড়ি চলে এল। পুলিশের কাছে দুই ভাই স্বীকার করল, তারা ধাক্কা দিয়ে তাদের বাবাকে কুয়ায় ফেলে দিয়েছে।
দমকল বাহিনীর লোক এসে গহিন কুয়া থেকে অনেক ঝামেলা করে মল্লিক সাহেবের ডেডবডি উদ্ধার করল।
মল্লিক সাহেবের ছোট ছেলের স্ত্রী
মল্লিক সাহেবের ছোট ছেলের স্ত্রী চম্পা এসেছে মিসির আলির কাছে। মল্লিক সাহেব এই ছেলের বউকেই ডাকতেন ছোট কুত্তি নামে।
মেয়েটি দেখতে কেমন মিসির আলি কিছুই বুঝলেন না। তার সারা শরীর গোলাপি রঙের বোরকায় ঢাকা। চোখ দেখা যাওয়ার কথা, তাও দেখা যাচ্ছে না। মশারির জালের আড়ালে চোখ। দুই হাতে কালো হাতমোজা। পায়ে টকটকে লাল লাল মোজা।
চাচাজি, আমার নাম চম্পা। আমি বক্কার স্ত্রী। আপনার কাছে বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি।
যাকে দেখা যাচ্ছে না। তার সঙ্গে স্বস্তি নিয়ে কথা বলা যায় না। এই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলা আর দূরের কারও সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা একই জিনিস।
মিসির আলি বললেন, মা! তুমি বসো। প্রয়োজনটা কী বলো?
চম্পা বসল। মিসির আলি লক্ষ রাখলেন এই মেয়ে তার স্বামীর মতো পা নাচায় কি না। পা নাচাচ্ছে না।
মিসির আলি বললেন, তোমার কী জরুরি কথা বলো।
চম্পা বলল, আমার স্বামী আর ভাসুরকে হাজত থেকে ছাড়াবার ব্যবস্থা করে দেন। তারা সম্পূর্ণ নির্দোষ।
মিসির আলি বিব্রত গলায় বললেন, এরা দুজনই খুনের মামলার আসামি। খুনের কথা স্বীকার করেছে। পুলিশ এদের ছাড়বে না।
চম্পা বলল, খুন এরা করে নাই। এই দুই ভাই খুবই ভালো মানুষ। এরা পিঁপড়াও মারে না। খুন কি করবে! খুন আমি আর আমার বড় বোন পারুল আপা মিলে করেছি। উনার খাবারের সঙ্গে এন্টাসি মিশায়ে দিয়েছি।
নিজেকে সামলাতে মিসির আলির কিছুটা সময় লাগল। এই মেয়ে সহজ গলায় এইসব কী বলছে। মিসির আলি বললেন, এন্টাসি কী জিনিস?
ইঁদুর মারা বিষ। কোনো গন্ধ নাই। লেবুর শরবতের সঙ্গে মিশায়ে দিয়েছি। কয়েক চুমুক দিয়ে উনি চিৎ হয়ে পড়ে গেছেন। মৃত্যু হওয়ার আগেই দুই ভাই মিলে লাশ কুয়াতে ফেলেছে।
তোমরা দুই বোন পুলিশকে এই কথা বলতে চাও?
জি, চাচাজি।
তোমরা যে হত্যা-পরিকল্পনা করেছিলে এইটা কি ছক্কা-বক্কা জানত?
না। তাদের বলি নাই।
বিষ কে কিনে এনেছে?
ইঁদুর মারা বিষ ঘরে ছিল, কেউ কিনে নাই।
খুন করেছ কী জন্যে?
উনি খুব খারাপ লোক ছিলেন। সপ্তাহে একদিন উনার কাছে আমার কিংবা আমার বোনের যেতে হতো। রাতে থাকা লাগত। আমার বড়বোন কখনো থাকে নাই। আমি থেকেছি। কখনো বলেছি আমার নাম পারুল, কখনো বলেছি চম্পা। আমরা দুই বোন দেখতে একই রকম। উনি ধরতে পারেন নাই।
তোমার স্বামী বা ভাসুর এই ঘটনা জানে?
জি জানে।
মিসির আলি বললেন, তুমি আমাকে যা বলেছ। পুলিশকে কি তা বলতে পারবে?
পারব। ইনশাল্লাহ।
তোমাদের দু’বোনের কথা আমি পুলিশকে জানাতে পারি। তার আগে তোমার বড় বোন পারুলের সঙ্গে আমার কথা বলতে হবে।
আমি আপনাকে যা বলেছি। পারুল আপা সেই কথাই বলবে। আলাদা কিছু বলবে না।
তারপরেও তার সঙ্গে আমার কথা বলা প্রয়োজন।
চম্পা বলল, আমি চেষ্টা নিব উনাকে পাঠাতে। তবে চেষ্টায় কাজ হবে না। পারুল আপা কারও সঙ্গে কথা বলে না। চাচাজি, তাহলে আমি যাই। আসসালামু আলায়কুম।
মিসির আলি কিছু বললেন না। ঘটনা শুনে তিনি ধাক্কার মতো খেয়েছেন। ধাক্কা সামলাতে তার সময় লাগছে।