- বইয়ের নামঃ যখন নামিবে আঁধার
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিরিজ বইঃ মিসির আলী
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প, উপন্যাস, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
গত তিন রাতেই ঘটনাটা ঘটেছে
গত তিন রাতেই ঘটনাটা ঘটেছে। অতি তুচ্ছ ব্যাপার। একে ‘ঘটনা’ বলে গুরুত্বপূর্ণ করা ঠিক না। তারপরেও মিসির আলি তাঁর নোটবুকে লিখলেন–
বিগত তিন রজনীতেই একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি হইয়াছে। রাত্রি তিনটা দশ মিনিটে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়াছে। ইহার কারণ অনুসন্ধান করিয়া পাইতেছি না।
মিসির আলির নোটবইটা চামড়ায় বাঁধানো। দেখে মনে হবে প্রাচীন কোনো বই। বইয়ের মলাটে সোনালি রঙে নাম লেখা–
ব্যক্তিগত কথামালা
ড. মিসির আলি
পিএইচডি
নোটবইটা তিনি কারও সামনে বের করেন না। বের না করার অনেকগুলো কারণের একটি হলো, তার কোনো পিএইচডি ডিগ্রি নেই। সাইকোলজিতে নর্থ ডেকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে এমএস ডিগ্রি পেয়েছিলেন। নামের আগে ‘ড.’ কখনো লিখতে পারেন নি। যদিও বিদেশ থেকে প্রচুর চিঠিপত্ৰ পান যেখানে তারা ভুল করে ‘ড. মিসির আলি’ লেখে।
শুদ্ধ দ্রুত প্রবাহিত হয় না। ভুল হয়। নিজের দেশেও অনেকেই মনে করে তার পিএইচডি ডিগ্রি আছে। বিশেষ করে তার ছাত্ৰ-ছাত্রীরা।
চামড়ায় বাঁধানো এই নোট বইটা তাঁর এক ছাত্রী দিয়েছিল। ছাত্রীটির নাম রেবেকা। নোট বইটার সঙ্গে রেবেকার একটা দীর্ঘ চিঠিও ছিল। যে চিঠি পড়লে যে-কোনো মানুষের ধারণা হবে, রেবেকা নামের তরুণী তার বৃদ্ধ শিক্ষকের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। চিঠির একটি লাইন ছিল এ রকম–‘স্যার, যে-কোনো কিছুর বিনিময়ে আমি আপনার পাশে থাকতে চাই। কে কী মনে করবে তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’
চিঠি পড়ে মিসির আলি তেমন শঙ্কিত বোধ করেন নি। তিনি জানেন, তরুণী মেয়েদের হঠাৎ আসা আবেগ হঠাৎই চলে যায়। আবেগকে বাতাস না দিলেই হলো। আবেগ বায়বীয় ব্যাপার, বাতাস পেলেই তা বাড়ে। অন্য কিছুতে বাড়ে না।
রেবেকা থার্ড ইয়ারে উঠেই ইউনিভার্সিটিতে আসা বন্ধ করল। মিসির আলি স্বস্তি বোধ করলেন। মেয়েদের হঠাৎ ইউনিভার্সিটিতে আসা বন্ধ করা স্বাভাবিক ঘটনা। বিয়ে হয়ে গেছে, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে, কিংবা বিদেশে চলে গেছে। আজকাল ছাত্রীরাও বিদেশ যাচ্ছে। ইচ্ছে করলেই রেবেকার ব্যাপারটা তিনি জানতে পারতেন। তার বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করলেই জানা যেত। মিসির আলির ইচ্ছে করে নি।
মেয়েটা ভালো থাকলেই হলো। যদি কখনো দেখা হয় তাকে বলবেন, তুমি যে নোটবইটা আমাকে দিয়েছ, সেটা আমি যত্ন করে রেখেছি। মাঝে মধ্যে সেখানে অনেক ব্যক্তিগত কথা লিখি।
সমস্যা হচ্ছে, ব্যক্তিগত কথা মিসির আলির তেমন নেই। তিন বছর হলো ইউনিভার্সিটির চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। দুই কামরার একটা ঘর এবং অর্ধেকটা বারান্দা নিয়ে তিনি থাকেন। জসু নামের বার-তের বছরের একটা ছেলে আছে। বাজার, রান্নাবান্না, ঘর পরিষ্কার সব সে করে। সন্ধ্যার পর তিনি তাকে পড়াতে বসেন। এই সময়টা মিসির আলির খুব নিরানন্দে কাটে। এক বছর হয়ে গেল তিনি জাসুকে পড়াচ্ছেন। এই এক বছরেও সে বর্ণমালা শিখতে পারে নি। অথচ অতি বুদ্ধিমান ছেলে। গত সোমবার তাঁর এমন মেজাজ খারাপ হলো—একবার ইচ্ছে করল জসুর গালে থাপ্পড় লাগাবেন। সে ‘ক’ ‘খ’ পর্যন্ত ঠিকমতোই পড়ল। ‘গ’-তে এসে শুকনা মুখ করে বলল, এইটা কী ইয়াদ নাই।
মাঝে মাঝে মিসির আলির মনে হয়। জাসুর সবই ‘ইয়াদ’ আছে। সে ভান করে ইয়াদ নাই। জসুর সবকিছুই ‘ইয়াদ’ থাকে, শুধু অক্ষর ইয়াদ থাকে না-তা কী করে হয় ? মিসির আলি নিশ্চিত, ছেলেটি অতি বুদ্ধিমান। প্রায়ই তার সঙ্গে তিনি সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। সে আলোচনায় অংশগ্রহণও করে। হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে ঝিম ধরে বসে থাকে না।
তাঁর যে প্রতিরাতেই তিনটা দশ মিনিটেই ঘুম ভাঙে—এটা নিয়েও তিনি জাসুর সঙ্গে কথা বলেছেন। জসু গম্ভীর হয়ে বলেছে, চিন্তার বিষয়।
তিনি বলেছেন, চিন্তার কোনো বিষয় না। আমার মতো বয়েসী মানুষের মাঝরাত থেকে ঘুম না হওয়ারই কথা।
জসু তার উত্তরে বলেছে, কিন্তুক স্যার, প্রত্যেক রাইতে তিনটার সময় ঘুম ভাঙে, এই ঘটনা কী ? এইটা চিন্তার বিষয় কি না আপনে বলেন। দেখি আপনার বিবেচনা।
মিসির আলি তেমন কোনো ‘বিবেচনা’ এখনো দেখাতে পারেন নি। তবে তিনি চিন্তা করছেন।
জসু তাকে সান্তুনা দেওয়ার মতো করে বলেছে, আপনে চিন্তা করেন, আমিও চিন্তা করব। দেখি দুইজনে মিল-মিশ কইরা কিছু বাইর করতে পারি কি না। ‘নদী-খাল-বিল আসল জিনিস মিল।’
জসুকে অত্যন্ত পছন্দ করেন মিসির আলি। এতে অবশ্য প্রমাণিত হয় না যে, জসু চমৎকার একটি ছেলে। সমস্যাটা মিসির আলির। যে-ই মিসির আলির সঙ্গে কাজ করতে এসেছে তাকেই তিনি পছন্দ করেছেন। এদের অনেকেই টাকা-পয়সা নিয়ে ভোগে গেছে। জসুর ক্ষেত্রেও হয়তো এ রকম কিছু ঘটবে। তবে না ঘটা পর্যন্ত মিসির আলির ভালোবাসা কমবে না। সন্ধ্যার পর রোজ তিনি তাকে পড়াতে বসবেন। রাতে একসঙ্গে খেতে বসে অনেক জটিল বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলবেন। ঘুমানোর সময়ও কিছু গল্পগুজব হবে। দু’জন একই ঘরে ঘুমায়। মিসির আলির বড় খাটের পাশেই জপুর চৌকি। রাতে জম্মু একা ঘুমুতে পারে না বলেই এই ব্যবস্থা। তার খুবই ভূতের ভয়।