যাই হোক, আমার রাজপুত্র ডাক্তার। পড়াশোনা করেছেন আমেরিকায়। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। চোখের কর্নিয়া রিপ্লেসমেন্টের একটি বিশেষ অপারেশন তাঁর আবিষ্কার। মেডিকেল জার্নালে Haroon’s cornia grafting হিসেবে এর উল্লেখ আছে।
এই রাজপুত্রের ঢাকা শহরের ওয়ারীতে একটা দোতলা বাড়ি। আছে। বাড়ির নাম ‘ছায়াকুটির’। ছায়া আমার শাশুড়ির ডাকনাম। আমার শ্বশুর সাহেব স্ত্রীকে যে নামে ডাকতেন বাড়ির কপালেও সেই জুটল। তাদের দু’টা গাড়ি আছে। একটা কালো রঙের মরিস মাইনর, একটা লাল রঙের ভক্সওয়াগন।
আমার শ্বশুর সাহেব ব্যাংকার ছিলেন। হাসিখুশি ফুর্তিবাজ মানুষ। বিয়ের পানচিনিতে তাঁকে আমি প্রথম দেখি। আমাকে পাশে বসিয়ে তিনি বললেন, আমার ছেলে আমাকে ডাকে বাবুই। তাকে শেখানো হয়েছিল বাবাই ডাক। সে ডাকা শুরু করল বাবুই। আমি তার কাছে হয়ে গেলাম—
‘পক্ষী’। তুমিও আমাকে বাবুই ডাকবে। পুত্র এবং পুত্রবধূ দু’জনের কাজেই আমি পক্ষী হিসেবে থাকব। হা হা হা।
আমার শ্বশুর সাহেবকে আমার বাবুই ডাকা হয় নি। আমাদের বিয়ে হলো রাত আটটায়। উনি সেই রাতেই এগারোটার দিকে মারা গেলেন। বিয়ের আনন্দবাড়ি শোকে ডুবে গেল। আমার শাশুড়ি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন। আমি সাক্ষাৎ ডাইনি। আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম।
বাসর রাত নিয়ে কত সুন্দর সুন্দর গল্প শুনেছি। আমাদের বাসর ছিল বেহুলা-লক্ষিন্দর টাইপ বাসর। যেন আমাদের দু’জনের মাঝখানে কিলবিল করছে ভয়ঙ্কর কাল সাপ।
আমার শাশুড়ি শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কথাবার্তা খুব কম। বলতেন। শুধু নিজের ছেলের সঙ্গে গলা নিচু করে নানান কথা বলতেন। তিনি এক অর্থে ভাগ্যবতী ছিলেন। ছেলে পেয়েছেন মাতৃভক্ত। বিদ্যাসাগর মায়ের জন্যে সাঁতরে দামোদর নদী পার হয়েছিলেন। আমার শাশুড়ির ছেলে মায়ের জন্যে সাঁতরে যমুনা পার হতো। যদি সে সাঁতার জানত। হারুন সাঁতার জানে না।
হারুনের মাতৃভক্তির নমুনা না দিলে আপনি বুঝবেন না। আমি নমুনা দিচ্ছি। আমার শাশুড়ি তাঁর শোবার ঘরের দরজা কখনো বন্ধ করতেন না। সারারাত দরজা খোলা থাকত। কারণ তাঁর ছেলের ভয় পাওয়া রোগ আছে। ভয় পেলে সে যেন যে-কোনো সময় মা’র ঘরে যেতে পারে
সেই ব্যবস্থা। এমন অনেকবার হয়েছে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে দেখেছি, আমার বিছানার পাশে সে নেই। আমি আমার শাশুড়ির ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেছি, মাতা-পুত্ৰ খাটের উপর বসে গল্প করছে। দু’জনই আনন্দিত। আমি সবসময় চেষ্টা করতাম ওরা যেন আমার উপস্থিতি টের না পায়। কিন্তু
প্রতিবারই আমার উপস্থিতি আমার শাশুড়ি টের পেতেন এবং বিরক্ত কিন্তু শান্ত গলায় বলতেন, বৌমা তুমি শুয়ে পড়, আমি ওকে পাঠাচ্ছি।
আমার এবং হারুনের আলাদা কোনো জীবন ছিল না। মনে করুন রেস্টুরেন্টে খেতে যাব, সেখানেও আমার শাশুড়ি। হারুন মা’কে ছাড়া কোথাও যাবে না। আমার শাশুড়ি আপত্তি করতেন। তিনি বলতেন, তোরা দু’জন খেতে যাচ্ছিস যা। আমি কেন? হারুন রেগে গিয়ে বলত তোমাকে ছাড়া আমি যদি রেস্টুরেন্ট খেতে যাই, তাহলে আমার নাম হারুন রশীদ না। আমার নাম কুত্তা রশীদ। এরপর আর কারোই বলার কিছু থাকে। না।
তবে একবার শুধু আমরা দু’জন কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। গাড়ি হারুন ড্রাইভ করেছে। আমি বসেছি তার পাশে। কী আনন্দের ভ্রমণ যে সেটা ছিল! থামতে থামতে যাওয়া। দরিদ্র চায়ের দোকানে গাড়ি থামিয়ে চা খাওয়া। যাওয়ার পথে এক জায়গায় হাট পড়ল। আমরা গ্রাম্য হাটে ঘুরে বেড়ালাম। কাঁচামরিচ, পটলের দাম করলাম। হারুন বলল, ঐ দেখ গরু ছাগলের হাট। দূরদাম করে একটা ছাগল কিনে ফেলব। নাকি? আমি বললাম, কিনবেই যখন ছাগল কেন, এসো একটা গরু কিনে ফেলি। গাড়ির ছাদে করে নিয়ে যাই।
আনন্দ করতে করতে আমরা কক্সবাজারে পৌঁছলাম রাত আটটার দিকে। পর্যটনের একটা মোটেল আছে, শৈবাল নাম। সেখানে আমাদের একটা ডিলাক্সরুম বুকিং দেয়া ছিল। শৈবালের লাউঞ্জে এসে আমি হতভম্ব হয়ে দেখি, আমার শাশুড়ি বিশাল এক সুটকেস নিয়ে লাউঞ্জে বসে
আছেন। প্রথম ভাবলাম চোখে ভুল দেখছি। আমি হারুনের দিকে তাকালাম। সে আনন্দিত গলায়
বলল, তুমি সারপ্রাইজ হয়েছ কি-না বলো? আমি শীতল গলায় বললাম, সারপ্রাইজ হয়েছি।
সে বলল, বেশি সারপ্রাইজ না মিডিয়াম সারপ্রাইজ?
আমি বললাম, বেশি সারপ্রাইজ।
হারুন বলল, তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যে আমি এই কাজ করেছি। মা’কে প্লেনের
টিকিট কেটে দিয়ে এসেছিলাম। আমরা রওনা হবার পর মা প্লেনে উঠেছেন। আমাদের আগে
পৌছেছেন। ভালো করেছি না?
আমি বললাম, ভালো করেছ।
হারুন বলল, আমি সাঁতার জানি না তো। মা পাশে থাকলে ভয় নেই। মা আবার সাঁতারে এক্সপার্ট।
আমি শাশুড়ির কাছে গিয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে অনেকক্ষণ দোয়া করলেন।
কক্সবাজার ট্রিপটা আমার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার ধারণা সেখানেই আমি কনসিভ করি। এইসব জিনিস মেয়েরা বুঝতে পারে। আমি আমার বাবুর নামও ঠিক করে ফেলি। ছেলে হোক বা মেয়েই হোক, আমার বাবুর নাম হবে সাগর।
কক্সবাজার থেকে ফেরার আটমাসের মাথায় সাগরের জন্ম হলো। কী সুন্দর ফুটফুটে ছেলে। বড় বড় চোখ। আমি তার চোখের দিকে তাকালেই সাগর দেখতে পাই। বাবুকে যখনই কোলে। নিতাম আমার কাছে মনে হতো, আমার যা পাওয়ার আমি পেয়ে গেছি। এই পৃথিবীতে আমার আর কিছু চাইবার নেই। এক সেকেন্ডের জন্যেও বাবুকে চোখের আড়াল করতে ইচ্ছা করত না। বাধ্য হয়ে আমি বাবুকে না দেখে থাকতাম, কারণ আমি তখন। কেমিস্ট্রির লেকচারারশিপের চাকরি পেয়েছি। সরকারি কলেজের চাকরি। ক্লাস বেশি না, কিন্তু ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিনই
যেতে হতো। প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন খুবই কড়া।