খাবারে পটাশিয়াম সায়ানাইড দেয়া থাকলে মন্দ হত না। এক ধাক্কায় সব ঝামেলা থেকে মুক্তি। মৃত্যুর পর মায়ের মতো আত্মা হয়ে যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুরে বেড়ানো। হারুন ঠিক করলেন আত্মা হতে পারলে তিনি মাঝে মাঝে শায়লাকে ভয় দেখাবেন। ধরা যাক সে ক্লাস নিচ্ছে, হঠাৎ নিঃশ্বাস ফেলবেন। কিংবা রাতে শায়লা যখন ঘুমুবে তিনি তার পায়ের বুড় আঙুল কামড়ে ধরবেন। আত্মারা কি কামড়াতে পারে? মাকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে।
কী ভাবছ?
কিছু ভাবছি না।
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কিছু নিয়ে চিন্তা করছ।
হারুন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আত্মা নিয়ে চিন্তা করছি। Soul.
ও আচ্ছা।
আত্মার প্রপার্টি নিয়ে ভাবছি। তবে সমস্যা হচ্ছে আত্মা কোনো বস্তু না, পরা বস্তু। পরা বস্তুর ধর্ম পৃথিবীর বিজ্ঞান ধরতে পারবে না।
শায়লা বললেন, তুমি কি ভালো একজন ডাক্তার দেখাবে? একজন সাইকিয়াট্রিস্ট।
দেখাব। মিসির আলি সাহেবকে দেখাব। উনার সঙ্গে আজ দেখা হয়েছে।
সত্যি?
শায়লা, তুমি জানো আমি মিথ্যা কথা বলি না। জানো না?
জানি।
হারুনের খাওয়া শেষ হয়েছে। পানি খাওয়া দরকার। পানির গ্রাসের দিকে হাত বাড়িয়েও শেষ পর্যন্ত গুটিয়ে নিলেন। তার মন বলছে পানির গ্লাসেই মেশানো আছে ভয়ঙ্কর KCN. অবশ্যই পানির গ্লাসে মেশানো। পানি হবে বর্ণহীন। এই গ্রাসের পানি নীলচে।
চিঠিকন্যা শায়লা
মিসির আলি কুরিয়ারে একটা দীর্ঘ চিঠি পেয়েছেন। চিঠির প্রেরকের নাম শায়লা রশিদ। পুনশ্চতে লেখা— ড. হারুন রশিদ নামে যে চোখের ডাক্তার আপনার চিকিত্সা করছেন। আমি তাঁর স্ত্রী। দশ পৃষ্ঠার দীর্ঘ চিঠি, এক বৈঠকে লেখা এটা বোঝা যাচ্ছে। চিঠি লিখতে লিখতে উঠে গিয়ে আবার লিখতে বসলে শুরুর লেখায় টানা ভাব কমে যায়। লেখার গতি কমে যায় বলেই এটা হয়।
চিঠি না পড়েই মিসির আলি পত্ৰ লেখিকার বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন।
(ক) মহিলা ধৈর্যশীলা। যিনি এক বৈঠকে এত বড় চিঠি লিখবেন, তার ধৈর্য থাকতেই হবে।
(খ) মহিলা শান্ত। তাঁর মধ্যে অস্থিরতা নেই। মানসিক অস্থিরতার ছাপ লেখায় চলে আসে। এই মহিলার হাতের লেখায় অস্থিরতা নেই।
(গ) মহিলা অত্যন্ত গোছানো। কারণ তিনি চিঠি লেখার সময় বাংলা ডিকশনারি পাশে নিয়ে বসেছেন। ভুল বানান ডিকশনারি দেখে শুদ্ধ করেছেন।
(ঘ) মহিলা বুদ্ধিমতী। কারণ তিনি ব্যবস্থা করেছেন যেন মিসির আলি পুরো চিঠি পড়েন। সম্বোধনেই সেই ব্যবস্থা করা। মহিলা মিসির আলিকে ‘বাবা’ সম্বোধন করেছেন। ‘বাবা’ সম্বোধনে লেখা চিঠি অগ্রাহ্য করা কোনো পুরুষের পক্ষেই সম্ভব না। মেয়েদের পক্ষে ‘মা’ সম্বোধনের চিঠি অগ্রাহ্য করা। খুবই সম্ভব। তারা নানানভাবে। মা’ ডাক শুনে অভ্যস্ত। পুরুষরা ‘বাবা’ শুনে অভ্যস্ত না। কেউ বাবা ডাকলেই সেই ডাক পুরুষদের মাথার ভেতর ঢুকে যায়।
মিসির আলি চিঠি পড়তে শুরু করলেন। তাঁর হাতে একটা লাল কালির বল পয়েন্ট। চিঠির
কোনো কোনো জায়গা লাল কালি দিয়ে। আন্ডার লাইন করতে হবে বলে তাঁর ধারণা। এই কাজটা
প্রথম পড়াতেই শেষ হয়ে যাওয়া ভালো।
প্রিয় বাবা,
আমার বিনীত সালাম নিন।
মিসির আলি লাল কালি দিয়ে প্রিয় বাবা আন্ডার লাইন করলেন।
সম্বোধন পড়ে আপনি নিশ্চয়ই অবাক হয়েছেন। একজন চিরকুমার মানুষের কন্যা থাকার কথা না। কন্যাস্থানীয়া অনেকেই থাকবে, তারা বাবা। ডাকবে না। চাচা ডাকবে কিংবা আধুনিক কেতায় আংকেল ডাকবে। আপনাকে আমি কেন বাবা ডাকছি তা অন্য কোনো দিন। ব্যাখ্যা করব।
মিসির আলি আবারো লাল কালি দিয়ে দাগ দিলেন। ‘অন্য কোনো দিন ব্যাখ্যা করব’ এই বাক্যের নিচে দাগ পড়ল।
আপনি অনেকের অনেক জটিল সমস্যার সহজ ব্যাখ্যা দিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। আমি আপনাকে অতি জটিল একটা সমস্যা দিচ্ছি। সমস্যার ব্যাখ্যা আমি নিজে নিজে বের করেছি। ব্যাখ্যা ঠিক আছে কি-না। তা শুধু আপনি বলে দিবেন। এই দীর্ঘ চিঠিতে আমি শুধু সমস্যাটি বলব। ব্যাখ্যায় যাব না। আপনি রহস্য সমাধানের পর আমি আমার সমাধান বলব।
আপনার সঙ্গে ‘রহস্যসমাধান’ খেলা আমি খেলতে পারি না। আমার ধৃষ্ঠতা ক্ষমা করবেন। যাই হোক, এখন। সমস্যাটি বলি।
অল্পবয়সে আমার বাবা-মা দু’জনই মারা যান। আমি বড় হই আমার ছোট চাচার আশ্রয়ে। চাচা-চাচি দু’জনই মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ ছিলেন। আমার বাবা-মা নেই, এটা তাঁরা কোনোদিনই বুঝতে দেন নি। ছোট চাচিকে আমি চাচি না ডেকে সবসময়ই মা ডেকেছি। চাচাকে। বাবা ডাকতে শুরু করেছিলাম। চাচা ডাকতে দেন নি।
মিসির আলি লাল কলমে পুরো প্যারাটা দাগ দিলেন। তার ভুরু সামান্য কুঞ্চিত হলো। মেয়েটি তাঁকে কেন বাবা সম্বোধন করেছে তা মনে হয় পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। সে নিজের বাবাকে বাবা ডাকতে পারে নি। চাচাকে ডাকতে গিয়েছিল, অনুমতি পায় নি। কাউকে বাবা ডাকার তীব্র ইচ্ছা থেকেই কি বাবা সম্বোধন?
আমার চাচা-চাচি অনেক যাচাই-বাছাই করে আদর্শ এক পাত্রের সঙ্গে আমার বিয়ে দিলেন। পাত্র আদর্শ, কারণ তার চেহারা রাজপুত্রের মতো। আফ্রিকান কালো রাজপুত্র না, গ্রিক রাজপুত্র। আর্য সন্তান। আপনি তো আমার স্বামীকে দেখেছেন। বলুন সে রাজপুত্র না? এখন অবশ্যি চিন্তায় ভাবনায় চোখের নিচে কালি জমেছে। মাথায় টাক পড়েছে। মন্ত্রীপুত্র টেকো হলেও মানিয়ে যায়। টাক মাথার রাজপুত্র মানায় না।