মিসির আলিকে এই কথা বলতেই তিনি বললেন, কাঁচামাছ তো খারাপ কিছু না। জাপানিরা সুসি খায়। সুসি বানানো হয় কাঁচামাছ দিয়ে।
সমস্যা হচ্ছে আমরা জাপানি না, কাঁচামাছ খেতে অভ্যস্ত না। কাজেই আমি সকাল থেকে Stop watch দিয়ে ইস্ত্ৰিচাপা দেয়ার সময়টা বের করার চেষ্টা করছি। একটা ইলিশ মাছের লেজ এবং মাথা ছাড়া পুরোটাই নষ্ট হয়েছে। এখন Experient শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ইলিশ মাছ দিয়ে। যথেষ্টই টেনশন বোধ করছি। আমি একদিনের টেনশনেই অস্থির, বাংলাদেশের মেয়েরা রোজই এই টেনশনের ভেতর দিয়ে যায়— এটা ভেবে খুব অবাক লাগছে।
সন্ধ্যা থেকে ঝুম বৃষ্টি।
সাতটার মধ্যে ঢাকা শহরের সব রাস্তায় পানি। এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কাটায় কাটায় সাতটায় শায়লা উপস্থিত হলেন। তখনি। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। আমার মাথায় হাত। ইলেকট্রিসিটি ছাড়া বিখ্যাত ইস্ত্ৰি ইলিশ তৈরি হবে না।
বসার ঘরের টেবিলে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। মোমবাতির আলোয় শায়লা নামের মহিলাকে অপরূপ দেখাচ্ছে। অধ্যাপিকারা পড়াতে জানেন, সাজতে জানেন না কথাটা ঠিক না। শায়লা অতি বিনয়ের সঙ্গে মিসির আলিকে কদমবুসি করতে করতে বললেন, ভুলভাল চিঠি লিখে আপনাকে বিরক্ত করেছি। বাবা আমাকে ক্ষমা করেছেন তো?
মিসির আলি হাসলেন। শায়লা বললেন, ক্ষমা করে থাকলে মাথায় হাত রাখুন। মিসির আলি মাথায় হাত রাখলেন। সুন্দর সন্ধ্যা শুরু হলো। আমরা তিনজন একসঙ্গে বসেছি। আমাদের সামনে লেবু চা। ঝড়-বৃষ্টির রাতে লেবু চায়ে চুমুক দিতে অসাধারণ লাগছে। খোলা জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। হাওয়ায় মোমবাতির শিখা কাঁপছে। এখন মনে হচ্ছে ঝড়-বৃষ্টির রাতে ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়া এমন খারাপ কিছু না।
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে শায়লার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তোমার হ্যান্ডব্যাগে কি সব সময় পটাসিয়াম সায়ানাইড রাখ?
শায়লার মুখ হঠাৎ রক্তশূন্য হয়ে গেল। শায়লার কথা বাদ থাকুক, আমি নিজেই। হকচকিয়ে গেলাম। শায়লা যদি তার হ্যান্ডব্যাগে পটাশিয়াম সায়ানাইড রেখেও থাকেন মিসির আলির পক্ষে তা জানা কোনোক্রমেই সম্ভব না। উনার আর যাই থাকুক। X-ray চোখ নেই।
মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, তোমার ব্যাগে পটাসিয়াম সায়ানাইডের একটা ফাইল আছে কী করে সেটা বুঝলাম তোমাকে বলি। পটাশিয়াম সায়ানাইড নিয়ে তোমার অবসেশান। আছে। শ্বশুরবাড়িতে এই শব্দটা তুমি প্রায়ই উচ্চারণ করো। যে কারণে তোমার শাশুড়িও শব্দটি শিখেছেন এবং তার পুত্রকে সাবধান করেছেন।
কেমিস্ট্রির শিক্ষক হিসেবে পটাশিয়াম সায়ানাইড জোগাড় করা তোমার পক্ষে কোনো বিষয় না। তারচেয়েও বড় কথা তুমি M. S করেছে New York ইউনিভার্সিটি থেকে। তোমার থিসিস ছিল কোনো একটি Inorganic যৌগে KCN-এর সাহায্যে Carbon যুক্ত করা। Inorganic যৌগের নামটা যেন কী?
শায়লা যন্ত্রের মত বললেন, সিলিনিয়াস হাইড্রাইড।
মিসির আলি বললেন, এই ঘরে ঢোকার পর থেকে লক্ষ করছি, তুমি তোমার হ্যান্ডব্যাগ শরীরের সঙ্গে শুধু যে জড়িয়ে রেখেছ তা-না, শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকেও রাখছ। বাতাসের ঝাপটায় একবার তোমার শাড়ির আঁচল সরেও গেল। তুমি সঙ্গে সঙ্গে অতি ব্যস্ততার সঙ্গে তোমার ব্যাগটা ঢাকলে। এখন বলো তোমার ব্যাগে পটাশিয়াম সায়ানাইড আছে না? তুমি যদি বলো নাই তাহলে নাই। আমি তোমার ব্যাগ খুলে দেখব না।
শায়লা বিড়বিড় করে বললেন, পটাশিয়াম সায়ানাইড আছে। ত্রিশ গ্রামের একটা ফাইল।
চোখ কপালে উঠার ব্যাপারটা বাগধারায় আছে। বাস্তবে এই ঘটনা কখনো ঘটে না। ঘটার সামান্য সম্ভাবনা থাকলে আমার চোখ কপালে উঠে থাকত।
মিসির আলি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে একটা খাম রাখতে দিয়েছিলাম। খামটা আজ ভোলা হবে এবং খামে কী লেখা পড়া হবে।
আমি খাম এনে নিজের জায়গায় বসলাম। মিসির আলি শায়লার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি প্রথম চিঠিতে জানতে চেয়েছিলে তোমার পুত্ৰ সাগরের হত্যাকারী কে তা তুমি জানো। আমি জানি কি-না? আমিও জানি। সেটা একটা কাগজে লিখে রাখতে দিয়েছিলাম। তোমার সামনে একদিন খুব এই আশায়। এখন খোলা হবে।
মিসির আলি বললেন, কাগজে কী লেখা পড়ুন।
আমি বললাম, কাগজে লেখা
‘আ মারপ এক
ন্যা’।
মিসির আলি বললেন, অতি সহজ সাংকেতিক ভাষায় লিখেছি। অক্ষরগুলি আগ পিছে করলেই মূলটা বের হবে।
আমি লিখেছি–
‘আমার পত্র
কন্যা।‘
আমি শায়লার দিকে তাকালাম, তার চেহারা ভাবলেশহীন। কী ঘটছে না ঘটছে তা সে যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
মিসির আলি বললেন, ডায়লা তুমি বিয়ের পর M.S. করতে আমেরিকা যাও, ঠিক না?
শায়লা হা-সূচক মাথা নাড়ল।
জালাল আহমেদের সঙ্গে সেখানেই তোমার পরিচয়?
হ্যাঁ।
সাগর নামের ছেলেটি কি তোমাদের অবৈধ সন্তান?
শায়লা মুখ তুলে তাকালেন এবং কঠিন গলায় বললেন, না। আমি হারুনকে নিয়মমাফিক তালাক দিয়ে জালালকে বিয়ে করি। হারুনের সঙ্গে এমনিতেই আমার বিয়ে বৈধ ছিল না। আপনি এত কিছু জেনেছেন, এই তথ্যও নিশ্চয়ই জানেন সে Impotent.
জানি।
পুরো ইসলামি মতে নিউইয়র্কের এক মসজিদে আমাদের বিয়ে হয়। তারপরই সমস্যা শুরু হয়।
কী সমস্যা?
তার ধারণা হয় আমি মানসিকভাবে অসুস্থ। যে-কোনো সময় তাকে আমি খুন। করতে পারি। এইসব হাবিজাবি।
ডা. হারুনের যে সমস্যা আছে সেই সমস্যা?
হ্যাঁ।