আমি বললাম, বাচ্চা ছেলেটা কি তার নাম বলেছে?
হারুন বলেছেন, নামের আদ্যক্ষর বলেছে। বলেছে ‘S’, আপনি নিজে উৎসাহী হলে আপনাকে নিয়ে একদিন
বসব। ভয়ের কিছু নেই। একটা বোতামে আমি এবং আপনি আঙুল চেপে বসব। বোতামটা থাকবে
উইজা বোর্ডে।
আমি বললাম, উইজা বোর্ডটা কী?
একটা কার্ড বোর্ড। সেখানে A থেকে Z পর্যন্ত অক্ষরগুলি লেখা। এক জায়গায় Yes এবং | No লেখা। যখন বোতামে আত্মার ভর হবে। তখন আত্মা কঁপতে থাকবে। আত্মাকে তখন প্রশ্ন করবেন, আপনি কি এসেছেন? আত্মা তখন। বোতামটা টেনে Yes-এর ঘরে নিয়ে যাবে। এই হচ্ছে বেসিক প্রিন্সিপ্যাল। বুঝেছেন?
কিছুটা। কাছ থেকে না দেখলে পুরোপুরি বুঝব না।
একদিন রাতে মিসির আলি সাহেবকে নিয়ে বাসায় চলে আসবেন। হাতেকলমে দেখাব।
আমি বললাম, হাতেকলমে তো দেখাবেন না। আপনি দেখবেন আঙুলে বোতামে।
আমার রসিকতায় হারুন অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, আজ আমি ব্যস্ত আছি। অন্য একদিন আসুন।
আমি উঠে পড়লাম। ভূতবিষয়ক এই আলোচনা থেকে মিসির আলি কী উদ্ধার করবেন আমি বুঝতে পারছি না। বাচ্চা
একটা ছেলের আত্মা এসেছিল যার নামের আদ্যক্ষর ‘s’, এটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হতে পারে। তবে আমি লক্ষ করেছি, আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্যই মিসির আলির কাছে গুরুত্বহীন। এই ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হবে।
ডা. হারুনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জালাল আহমেদের ছবির খোজে বের হলাম। জালাল আহমেদের মা মারা গেছেন। বাবা একা বেইলী রোডের এক ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকেন। আমাকে কিছুতেই ঢুকতে দেবে না। অনেক ঝামেলা করে জালাল সাহেবের বাবার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাওয়া গেল। বৃদ্ধ অত্যন্ত সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। বৃদ্ধ আমাকে শীতল গলায় বললেন, আমি আপনাকে চিনি না, জানি না। কোনোদিন আপনার সঙ্গে আমার দেখাও হয়। নি।
আপনাকে আমি আমার ছেলের ছবি কেন। দেব? আপনি তো দূরের কথা, আমি তো আমার আত্মীয়স্বজনকেও কোনো ছবি দেব না। আমার ছেলে মারা গেছে, ধরে নেন তার ছবিও মারা গেছে।
আপনার ছেলে মারা গেছে তা তো জানতাম না। কবে মারা গেছে?
কবে মারা গেছে জেনে কী করবেন? মিলাদ পড়াবেন? অনেক কথা বলে ফেলেছি, যান। বিদায় হোন।
আমি দেয়ালের দিকে তাকালাম। দেয়ালভর্তি এক যুবকের নানান ভঙ্গিমার সুন্দর সুন্দর ছবি। রাজপুত্রের মতো রূপবান সেই যুবক বসার ঘরের দেয়াল আলো করে রেখেছে। এই যুবক যে জালাল আহমেদ তাতে সন্দেহ নেই। একটি ছবি এত সুন্দর যে সেই ছবি দিয়ে ক্যালেন্ডার করা যায়। যুবক জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে আছে। তার পেছনে নীল সমুদ্র। যুবকের চোখে বিষন্নতা। তার হাতে একটা মগ। মনে হচ্ছে সে মর্গে করে কফি খাচ্ছে।
আমি বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনার ছেলের ছবি?
বৃদ্ধ দাঁত মুখ খিচিয়ে বললেন, আমার ছেলের ছবি না। পাড়ার ছেলের ছবি। পাড়ার ছেলের ছবি দিয়ে আমি দেয়াল ভর্তি করে রেখেছি।
আমি মুগ্ধ কণ্ঠে বললাম, পুরুষমানুষ যে এত রূপবান হতে পারে এই প্রথম দেখলাম।
এই কথাতেই কাজ হলো। বৃদ্ধের চোখ থেকে কাঠিন্য মুছে গেল। সেখানে চলে এলো এক ধরনের বিষন্নতা। বৃদ্ধ বললেন, চা খাবেন?
আমি বললাম, চা না, কফি খেতে ইচ্ছা করছে। জাহাজের ডেকে আপনার ছেলের কফি খাওয়া দেখে আমার কফি খেতে ইচ্ছা করছে। আপনার বাসায় কফির ব্যবস্থা কি আছে?
বৃদ্ধ বললেন, অবশ্যই আছে। আমার ছেলে যে মগে করে কফি খাচ্ছে সেই মগটাও আছে। ঐ মগে করে খেতে চান?
আমি বললাম, এত সৌভাগ্য আমি আশা করছি না। কফি হলেই আমার চলবে।
বৃদ্ধ আমাকে ছেলের কফি মগেই কফি দিলেন। চোখ মুছতে মুছতে ছেলের মৃত্যুর ঘটনা বললেন। নিউইয়র্কের সাবওয়েতে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে মৃত্যু।
জালাল আহমেদের ছবি নিয়ে বাসায় ফিরলাম। জাহাজে কফি খাওয়ার ছবিটাই আমাকে দিলেন। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, আমার ছেলের এই ছবিটা আপনার পছন্দ হয়েছে, আপনি নিয়ে যান। ফেরত দিতে হবে না। ছবি আপনার কেন দরকার, ছবি দিয়ে কী করবেন কিছুই জানতে চাচ্ছি না। আজকাল কিছুই জানতে ইচ্ছা করে না। কফি খেতে চাইলে আমার কাছে এসে কফি খেয়ে যাবেন। আমার ছেলের কফি খুব পছন্দ ছিল। মৃত্যুর সময়ও তার হাতে কফির কাপ ছিল।
ডিনারের নিমন্ত্রণ
আজ সোমবার।
মিসির আলি সাহেবের চিঠিকন্যা শায়লার আমাদের এখানে ডিনারের নিমন্ত্রণ। তিনি নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। টেলিফোনে জানিয়েছেন সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ চলে আসবেন।
আমি কয়েকটি কারণে কিছুটা উত্তেজনার মধ্যে আছি। প্রথম কারণ, অতিথির জন্যে রান্নার দায়িত্ব পড়েছে আমার। মেনু মিসির আলি ঠিক করে দিয়েছেন
স্টার্টার : জিরাপানি
সাইড ডিস : বেগুন ভর্তা, টমেটো ভর্তা।
মেইন ডিস : ইস্ত্ৰি ইলিশ
ফিনিশিং : মুগের ডাল
ডেজার্ট : দৈ।
মেইন ডিস নিয়ে আমি যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় আছি। মেইন ডিসের নামই দুশ্চিন্তার জন্যে যথেষ্ট ইস্ত্ৰি ইলিশ। এই রান্না মিসির আলির আবিষ্কার। ইলিশ মাছে সর্ষে বাটা, কাঁচামরিচ এবং লবণ দেয়ার পর লাউপাতা দিয়ে মুড়তে হবে। তারপর গরম ইস্ত্রির নিচে বসিয়ে দিতে হবে। কিছুক্ষণ পর মাছ উল্টে আবার ইস্ত্ৰি চাপা। দেয়া। ইস্ত্রি দিয়ে কতক্ষণ চাপা দিয়ে রাখতে হবে, সেই সম্পর্কে মিসির আলি কিছু বলছেন না। আমার ধারণা মেইন ডিস হবে কাঁচামাছ।