এক্ষুনি বের করছি।
মিসির আলি বললেন, ভেরি গুড। পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা না। ইন্টারনেট আমাদের জীবন অনেক সহজ করে দিয়েছে।
ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা গেল Haroon’s Cornia grafting বলে কিছু নেই, তবে Jalal Ahmed’s Cornia grafting বলে নতুন এক পদ্ধতি আছে।
মিসির আলিকে এই তথ্য দিতেই তিনি বললেন, জালাল আহমেদ মুসলমান নাম। তার মানে এই না যে তার দেশ বাংলাদেশ। সে পাকিস্তানি হতে পারে, মিডল ইস্টের হতে পারে। আপনার কাজ হচ্ছে মেডিকেল কলেজগুলিতে খোজ নেয়া এই নামে কোনো ছেলে পাশ করেছে কি না।
আমি হতাশ গলায় বললাম, আপনি কি এইভাবেই রহস্য ভেদ করেন?
মিসির আলি বললেন, অবশ্যই। দ্বিতীয় বিকল্প তো নেই। যাইহোক, আপনার এই কাজটা সহজ করে দিচ্ছি। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি জালাল আহমেদ নামে অসম্ভব ব্রিলিয়েন্ট একজন ছাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেছে। সে যে শুধু ব্রিলিয়েন্ট তা-না, সে রাজপুত্রের মতো রূপবান। তাকে প্রিন্স নামে ডাকা হতো।
আমি শুধু বললাম, ও আচ্ছা। জালাল আহমেদ নামে নতুন এই চরিত্রটির সঙ্গে রহস্যের কী সম্পর্ক কিছুই বুঝতে পারছি না। জট খুলতে গিয়ে আরো জট পাকিয়ে দিচ্ছি এই হলো সমস্যা। মিসির আলির রহস্যভেদ প্রক্রিয়া যে এমন ঝামেলার তাও আগে বুঝি নি। এখানে-ওখানে যাওয়া, ঘোরাঘুরি, বিরাট পরিশ্রমের ব্যাপার।
মিসির আলি বললেন, আমার চিঠিকন্যার চিঠিটা মনে করুন। সেখানে লেখা আমার স্বামী রাজপুত্রের মতো। এখন আপনি বলুন, হারুন সাহেব কি রাজপুত্রের মতো?
না।
হারুন’স কর্নিয়া গ্রাফটিং বলে কিছু নেই, অথচ জালাল আহমেদ’স কর্নিয়া গ্রাফটিং আছে। যে জালাল রাজপুত্রের মতো সুন্দর। কিছু কি বোঝা যাচ্ছে?
আমি হতাশ গলায় বললাম, না।
মিসির আলি বললেন, আমার চিঠিকন্যা হাসপাতালের ঠিকানায় একটা চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিটা পড়ে দেখতে পারেন। আরো কোনো ক্ল যদি পাওয়া যায়।
আমি বললাম, চিঠি পড়ে ক্লু বের করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আগের চিঠিতে কিছু পাই নি, এই চিঠিতেও কিছু পাব না।
মিসির আলি হো হো করে আসছেন, যেন। আমি খুবই মজার কোনো কথা বলেছি।
এইবারের চিঠিটা আমি পরপর তিনবার পড়লাম। আগের চিঠি মিসির আলি তিনবার পড়তে বলেছিলেন, এই কারণেই এই চিঠিও তিনবার পড়া। চিঠিটা হলো–
বাবা,
আমি আপনার চিঠিকন্যা শায়লা। আপনার শরীর খারাপ এবং আপনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, এই খবর আমি হারুনের কাছ থেকে পেয়েছি। সে আপনার সব খবর রাখে। আপনি যে একজন লেখকের বাড়িতে উঠেছেন, এই খবরও তার কাছে পেয়েছি। আমার ধারণা সে আপনার পেছনে স্পাই লাগিয়েছে।
বাবা, আপনাকে যে কথা বলার জন্যে চিঠি লিখছি তা হলো ক্ষমা প্রার্থনা। মিথ্যা কথা। বলে আপনার সময় নষ্ট
করেছি, এইজন্যে ক্ষমা প্রার্থনা। আমি অত্যন্ত ছেলেমানুষি একটা কাজ করেছি। বানিয়ে বানিয়ে বলেছি। আমার ছেলের মৃত্যুর কথা। আপনাকে রহস্য ভেদ করতে বলেছি। কারণটা ব্যাখ্যা করি। আমি আপনাকে নিয়ে লেখা প্রায় সব বইই পড়েছি। হঠাৎ ইচ্ছা হলো অতি বুদ্ধিমান মিসির আলিকে বিভ্রান্ত করা যায় কি-না। দেখা যাক।
আমার ধারণা ছিল চিঠি পড়েই আপনি বুঝবেন পুরোটাই বানানো। তা-না করে আপনি যে রীতিমতো গবেষণা শুরু করেছেন। তা জানলাম যখন আপনি আপনার লেখক বন্ধুকে আমার কাছে পাঠালেন। আপনার লেখক বন্ধু বললেন, ঐ বছরের পহেলা এপ্রিল সরকারি ছুটি। মিথ্যা বলার এই বিপদ।
সত্যি সত্যি ঘটনাটা ঘটলে আমার মনে থাকতো সে বছরের পহেলা এপ্রিল সরকারি ছুটি ছিল।
বাবা, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনাকে বাবা ডেকেছি, কাজেই কন্যা হিসেবে ক্ষমা পেতে
পারি।
আমার ইচ্ছা ছিল হাসপাতালে আপনার সঙ্গে দেখা করা। চক্ষুলজ্জায় দেখা করতে পারি নি।
বাবা, আপনি আমাকে যদি ক্ষমা করেন তাহলেই একদিন এসে আপনাকে দেখে যাব। আমার এতই খারাপ লাগছে, ইচ্ছা করছে KCN খেয়ে মরে যাই।
ইতি
চিঠিকন্যা শায়লা
তিনবার চিঠি পড়ার পর আমি বললাম, আমি যা ভেবেছিলাম ঘটনা তো সেরকমই। মামলা ডিসমিস।
মিসির আলি গম্ভীর গলায় বললেন, মামলা মাত্র শুরু। ডিসমিস মোটেই না। আমি মেয়েটিকে সোমবার সন্ধ্যায়
আসতে বলেছি। রাতে আমাদের সঙ্গে খেতে বলেছি। এর মধ্যে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে জালাল আহমেদের একটা ছবি জোগাড় করতে হবে।
কোত্থেকে জোগাড় করব?
আমি বলে দেব কোত্থেকে।
আর কিছু করতে হবে?
ডাক্তার হারুনের সঙ্গে ভূতবিষয়ক একটা মিটিং। আপনি তাঁকে ভূতবিষয়ক নানান তথ্য দেবেন।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ভূতবিষয়ে আমি কী তথ্য দেব? আমি তো কিছুই জানি না।
মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, আমি শিখিয়ে দেব।
এতে লাভ কী হবে?
পরকালে বিশ্বাসী লোকজন মৃতদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যে অনেক কর্মকাণ্ড করে, যেমন প্ল্যানচেট, চক্ৰ। আমি শুধু জানতে চাই তিনি মৃত কোনো মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন কিনা।
আমি বললাম, ভূত-প্ৰেত বিষয়ক আলোচনায় আপনি থাকবেন তো?
মিসির আলি না-সূচক মাথা নাড়লেন। ভাবলেশহীন গলায় বললেন, পুরো প্রক্রিয়াটি আমি আপনাকে দিয়ে করাতে চাই। নিজে নিজে রহস্যভেদ করতে চাচ্ছিলেন সেই সুযোগ করে দিচ্ছি। তবে এখনো সময় আছে। আপনি যদি সরে আসতে চান সরে আসবেন।
আমি সরে আসতে চাই না।
ডা. হারুনের সঙ্গে ভূতবিষয়ক আলোচনা তেমন জমল না। তিনি সেদিন কথা বলার মুডে ছিলেন না। তবে তিনি বললেন, রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁর নিজেরও প্ল্যানচেটের উপর অগাধ বিশ্বাস। তাঁর মা জীবিত থাকার সময় মা’র সঙ্গে অনেকবার প্ল্যানচেট করেছেন। প্ল্যানচেটে সাধারণ মানুষের আত্মা যেমন এসেছে বিখ্যাত ব্যক্তিদের আত্মাও এসেছে। প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি সুকান্ত, নবাব সিরাজউদ্দৌলা…। তাঁর কাছ থেকে জানলাম তিনি এবং তাঁর স্ত্রী শায়লা একবারই বসেছিলেন প্ল্যানচেটে। খুবই বাচ্চা একটা ছেলের আত্মা এসে উপস্থিত হয়। শায়লা এই ঘটনায় প্রচণ্ড ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর তিনি আর কখনো প্ল্যানচেটে বসেন নি।