আমি বললাম, আপনি তো বিনা পরিশ্রমেই রহস্যের মীমাংসা করে ফেলেছেন। অনেক আগেই খামে লিখে আমাকে দিয়েছেন।
মিসির আলি বললেন, বিনা পরিশ্রমে করি নি। অনেক পরিশ্রম করেই সিদ্ধান্তে এসেছি। কঠিন এক অংক ধাপে ধাপে করে সিদ্ধান্তে এসেছি। আপনার পক্ষে গোরস্থানে গোরস্থানে। ঘোরা সম্ভব হবে না আমি বুঝতে পারছি। এক কাজ করুন, কিছু টাকাপয়সা দিয়ে কাউকে লাগিয়ে দিন, যে আপনার হয়ে কাজটা করবে। পাঁচশ টাকা খরচ করলেই হবে।
আমাকে এক হাজার টাকা খরচ করতে হলো। গোরস্থান থেকে গোরস্থানে যাবার ভাড়া পাঁচশ টাকা। কাজটার জন্যে পাঁচশ’ টাকা। জানতে পারলাম ঢাকা শহরে ঐ তারিখে। এগারোজন শিশু মারা গেছে। এর মধ্যে পাঁচজন মেয়ে। ছয়জন ছেলের মধ্যে চারজনের বয়স চার বছরের বেশি। এরা বাদ। বাকি দু’জনের একজন জন্মের পরপরই মারা গেছে। সেও বাদ। একজন শুধু মারা গেছে এক বছর বয়সে। তার নাম মিজান। তার বাবা আলহাজ আব্দুল লতিফ। থাকেন পুরনো ঢাকায়।
আমি আমার রিপোর্টে লিখলাম নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি পহেলা এপ্রিলে হারুন সাহেবের কোনো সন্তান মারা যায় নি।
রিপোর্টটা লিখে শান্তি পেলাম না। মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল। আমার ধারণা এর মধ্যেও মিসির আলি কিছু ভুল বের করে ফেলবেন। আবার আমাকে নতুন করে ছোটাছুটি শুরু করতে হবে। হয়তো মিসির আলি বলবেন, আলহাজ আব্দুল লতিফ সাহেবের ইন্টারভ্যু নিতে।
অনেক চিন্তাভাবনা করে আমি একটা সহজ পথ বেছে নিলাম। মিসির আলি সাহেবের খামটা খুলে ফেললাম। সেখানে লেখা
“ধৈর্য ধরতে পারলেন না? আগেভাগেই খাম খুলে ফেললেন? যাইহোক, হত্যাকারীর নাম লিখছি। সাংকেতিকভাবে লিখছি। দেখি সংকেত ভেদ করতে পারেন কিনা। হত্যাকারীর নাম–
‘আ মারপ এক ন্যা।’
আমার মাথায় হাত দিয়ে বসা ছাড়া উপায় রইল না। সাংকেতিক ভাষা উদ্ধার আমার কর্ম না। মিসির আলি সাহেবের নির্দেশ মতো অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া এরচে’ সহজ। মনে হচ্ছে পেতেছি সমুদ্রে শয্যা।
ভূতবিষয়ক প্রবন্ধ
মিসির আলি হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন এবং গভীর আগ্রহে রাত জেগে ভূতবিষয়ক প্রবন্ধ লিখে যাচ্ছেন। পানিভূত বিষয়ে আগেই লেখা হয়েছে। এখন লিখছেন বৃক্ষবাসী ভূত। যেসব ভূত গাছে বাস করে তাদের নিয়ে জটিল প্রবন্ধ। যা লেখেন সেটা আমাকে ঘুমুতে যাবার আগে পড়ে শোনান। আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না নিতান্ত ফালতু কাজে এই মানুষটা কেন তার মেধা নষ্ট করছে। ভূতবিষয়ক আলোচনায় আমি অংশগ্রহণ করছি। একটা শিশু যদি গভীর আগ্রহে কোনো খেলা খেলে সেই খেলায় বাধা দিতে নেই। ভূতবিষয়ক গবেষণা শিশুর খেলা ছাড়া আর কী? শিশুর খেলাকে প্রশ্রয় দেয়া সাধারণ নর্মের মধ্যে পড়ে।
রাতে দু’জন খেতে বসেছি, মিসির আলি বললেন, বলুন তো দেখি কোন কোন গাছে ভূত থাকে?
আমি বললাম, জানি না। আমি এখন পর্যন্ত কোনো গাছে ভূত থাকতে দেখি নি।
মিসির আলি বললেন, চার ধরনের গাছে ভূত থাকে। বেলগাছ, তেঁতুলগাছ, শ্যাওড়াগাছ এবং বাঁশগাছ। এর বাইরে কোনো গাছে থাকে না। আম এবং কাঁঠাল গাছে ভূত থাকে এরকম কথা কখনো শুনবেন না।
আমি বললাম, ও আচ্ছা।
মিসির আলি বললেন, ভূত মানুষের কল্পনা, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু মানুষ কেন ভূত থাকার জন্যে চারটা মাত্র গাছ বেছে নিল এটার গবেষণা হওয়া দরকার।
এই গবেষণায় আমাদের লাভ?
মিসির আলি বললেন, এই গবেষণা মানুষের কল্পনার জগৎ সম্পর্কে কিছু ধারণা দেবে।
আমি বললাম, শ্যাওড়া ঘন আঁকড়া গাছ। দিনেরবেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকে।
সেইজন্যেই মানুষ শ্যাওড়া গাছকে ভূতের জন্যে বেছে নিয়েছে।
মিসির আলি বললেন, বেলগাছ তো কঁকড়া গাছ না। ছায়াদায়িনী বৃক্ষও না। তাহলে বেলগাছ বাছল কেন?
বেলগাছে কাঁটা আছে এই কারণে। ভূতরা হয়তো কাঁটা পছন্দ করে।
তেঁতুল এবং বাঁশ গাছে তো কাঁটা নেই। ভূতরা তাহলে ঐ গাছে কেন থাকছে?
আমি চুপ করে গেলাম। প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্যে বললাম শায়লার পুত্রের মৃত্যুরহস্য ভেদের কাজটা শেষ করে ভূতের গবেষণাটা করলে ভালো হয় না?
মিসির আলি বললেন, রহস্য তো অনেক আগেই ভেদ হয়েছে। উত্তর লিখে খামে সীলগালা করে আপনার হাতে দিয়েছি। এখন আপনার দায়িত্ব নিজের মতো করে রহস্যের মীমাংসায় আসা।
কোন দিকে আগাব বুঝতে পারছি না তো।
আমার চিঠিকন্যা শায়লা আমাকে যে চিঠি লিখেছে সেটা ধরে আগাবেন।
সেটা ধরে আগানোর তো আর কিছু নেই।
মিসির আলি বললেন, অবশ্যই আছে। চিঠিতে লেখা— ডা. হারুন চোখের কর্নিয়া গ্রাফটিং-এর একটা পদ্ধতি বের করেছে, যার নাম Haroon’s Cornia grafting. দেখতে হবে আসলেই এমন কোনো পদ্ধতি ডাক্তার হারুন বের করেছে কি-না?
তার প্রয়োজনটা কী? উনি এই পদ্ধতি বের না করলেও তো কিছু আসে যায় না। শিশুর মৃত্যুর সঙ্গে কর্নিয়া গ্রাফটিং-এর কোনো সম্পর্ক নেই।
মিসির আলি বললেন, রহস্যভেদের জন্যে কোনো তথ্যই অপ্রয়োজনীয় না।
আমি বললাম, গ্রাফটিংবিষয়ক তথ্য পাব কোথায়?
মিসির আলি বললেন, সব মেডিকেল কলেজের লাইব্রেরিতে জার্নাল আছে। সেখান। থেকে পাবেন। তারচেয়েও সহজ বুদ্ধি হলো Internet. Haron’s cornia grafting লিখে সার্চে দিলেই পাওয়া যাবে। আমি তো সেভাবেই বের করেছি। এবং আপনার কম্পিউটারেই বের করেছি।
কী পেয়েছেন?
সেটা তো আপনাকে বলব না। আপনি রহস্যভেদ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আপনি নিজে বের করবেন।