আমি আমতা আমতা করে বললাম, ভুল হয়েছে। কিছু মনে করবেন না।
হারুন বললেন, কিছু মনে করছি না। মানুষ ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক। এখন বলুন, কী খাবেন? চা নাকি কফি। এক কাজ করুন, দুটাই খান। প্রথমে চা তারপরে কফি। চা-কফি খেতে খেতে পানিভূত বিষয়ে কী জানেন বলুন তো।
আমি বললাম, আমি কিছুই জানি না। জানতে চাচ্ছিও না। এইসব অতিপ্রাকৃত বিষয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই।
হারুন মহাউৎসাহে বললেন, আগ্রহ কেন থাকবে না? আপনার কি ধারণা ভূত-প্ৰেত নেই? রবীন্দ্রনাথ ভূত বিশ্বাস করতেন, এটা জানেন? প্ল্যানচেট করে আত্মা আনতে পছন্দ করতেন। তিনি তার জীবনস্মৃতি’তে পরিষ্কার লিখেছেন। আপনি ‘জীবনস্মৃতি’ পড়েন নি? আমার কাছে আছে, আপনি ধার নিতে পারেন। তবে বই ধার নিলে কেউ ফেরত দেয় না, এটাই সমস্যা।
পুলিশ তদন্ত করে ফাইনাল রিপোর্ট দেয়, আমিও শায়লার সন্তান বিষয়ে একটা ফাইনাল রিপোর্ট তৈরি করলাম। মিসির আলি সাহেবকে রিপোর্ট দেখিয়ে চমকে দেব এটাই আমার বাসনা। আমার ধারণা রিপোর্টটা ভালো
লিখেছি।
ডা. হারুনের সন্তানের মৃত্যুবিষয়ক জটিলতা
(ক) ডা. হারুনের কোনো সন্তান নেই, সন্তানের মৃত্যুর প্রশ্নও সেই কারণেই নেই।
ডা. হারুনের প্রকৃতি ভালো মানুষের প্রকৃতি। ভালো মানুষরা নিজের বিশ্বাসের প্রতি শ্ৰদ্ধাশীল হয়, এই ভদ্ৰলোকও সেরকম। ভূত-প্ৰেত-আত্মা এইসব বিষয়ে তার বিশ্বাস আছে। বিশ্বাস রক্ষার ব্যাপারে তিনি যত্নশীল। এটা দোষের কিছু না। এধরনের মানুষরা অপ্রয়োজনীয় মিথ্যা বলেন না। কাজেই তার কোনো সন্তান। নেই এমন মিথ্যা তিন বলবেন না।
তারপরেও হারুন সাহেবের কথার সত্যতা সম্পর্কে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হবার জন্যে আমি দু’জনের সঙ্গে কথা
বলেছি। একজন। হারুন সাহেবের গাড়ির ড্রাইভার এবং অন্যজন হারুন সাহেবের বাড়ির কেয়ারটেকার নাজমুল।
নাজমুলের অনেক বয়স। হারুনের জন্মের আগে থেকেই তাদের বাড়ির কেয়ারটেকার। স্ট্রোকের কারণে ডানহাত এবং পা নাড়াতে পারেন না। মুখের কথাও অস্পষ্ট এবং জড়ানো। তবে তার সেন্সেস পুরোপুরি কাজ করছে। আমার প্রশ্নের
জবাবে বললেন—
আমার নিজের কোনো ছেলেমেয়ে নাই। আমি বিবাহ করি নাই। আমি মনে করি। আমার ছেলে হারুন। আমি তাকে কোলেপিঠে বড় করেছি। ঘাড়ে করে স্কুলে নিয়ে গেছি। স্কুল থেকে এনেছি। তার কোনো সন্তানাদি হয় নাই, এই দুঃখ হারুনের চেয়ে আমার অনেক বেশি। আর অল্প কিছুদিন বেঁচে থাকব। হারুনের বাচ্চার মুখে দাদু ডাক শুনব না, এই কষ্টের কোনো সীমা নাই।
ডা. হারুনের ড্রাইভারের সাথে আমার যে কথা হয়েছে তা এরকম–
আমি : তোমার নাম?
ড্রাইভার : স্যার, আমার নাম ফজলু। ফজলু মিয়া।
আমি : তুমি ডাক্তার সাহেবের গাড়ি কতদিন ধরে চালাচ্ছ?
ড্রাইভার : হিসাব নাই। কাজ শিখার পরে প্রথম স্যারের। এখানে কাজ নেই। খুব কম হইলেও দশ বছর ধইরা স্যারের সাথে আছি।
আমি : তোমার ডিউটি কেমন?
ড্রাইভার : আমার ডিউটি নাই বললেই চলে। স্যারের সন্তানাদি নাই, ইস্কুল ডিউটিও নাই।
আমি : ম্যাডামের ডিউটি কর না?
ড্রাইভার : ম্যাডামের আলাদা গাড়ি। আলাদা ড্রাইভার।
(খ) সন্তানবিষয়ক মিথ্যা কথাটা শায়লা বানিয়ে বলেছেন। এমন একটা ভয়ঙ্কর কথা উনি কেন বানালেন সেটা খুব পরিষ্কার না। আমার ধারণা তিনি মিসির আলি সাহেবের সঙ্গে একটা বুদ্ধির খেলা খেলেছেন। মিসির আলি একজনকে শিশুর হত্যাকারী হিসাবে চিহ্নিত করার পর তিনি বলবেন, কোনো শিশুর অস্তিত্বই নাই। সম্মানিত মানুষকে ছোট করে অনেকে আনন্দ পায়। শায়লা সেরকম একজন বলে আমার ধারণা।
মিসির আলি আগ্রহ নিয়ে আমার রিপোর্ট পড়লেন। এবং হাসিমুখে বললেন, রিপোর্ট ঠিক আছে,
তবে …।
আমি বললাম, রিপোর্ট ঠিক থাকলে তবে আসবে কেন?
মিসির আলি বললেন, তবে আসছে, কারণ হারুন সাহেবের কোনো ছেলে পহেলা এপ্রিল মারা যায় নি বলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা যুক্তিনির্ভর না। আপনি হারুন সাহেবের কথা, তাঁর কেয়ারটেকার এবং ড্রাইভারের কথা সত্যি বলে ধরে নিয়েছেন। তারা কেন মিথ্যা বলবে? হারুন সাহেবের স্ত্রীইবা কেন মিথ্যা বলবে?
আমি বললাম, হারুন সাহেবের স্ত্রীর মিথ্যা বলার কারণ কিন্তু আমি ব্যাখ্যা করেছি। তিনি আপনার সঙ্গে একটা খেলা খেলছেন।
মিসির আলি বললেন, এই খেলা তো হারুন সাহেবও খেলতে পারেন। পারেন না?
আমি বললাম, তাঁর বাড়ির বাকি দু’জন তো কোনো খেলা খেলবে না। তাদের স্বার্থ কী?
অন্নদাতা মুনিবকে রক্ষা করা স্বার্থ হতে পারে। বাড়ির বিশ্বাসী পুরনো লোকজন মুনিবের প্রতি Loyal থাকে।
আমি বললাম, আপনি কি তাহলে ধারণা করছেন যে পহেলা এপ্রিল সত্যি সত্যি বাচ্চাটা খুন হয়েছে?
মিসির আলি বললেন, সেরকম ধারণাও করছি না। তবে আমি মনে করি ঐ তারিখে ডাক্তার হারুনের কোনো বাচ্চা মারা গিয়াছিল কি-না সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়াটা খুব জরুরি।
আমি বললাম, কীভাবে নিশ্চিত হব? বাংলাদেশে তো জন্ম-মৃত্যুর কোনো রেকর্ড থাকে না।
মিসির আলি বললেন, জন্মরেকর্ড থাকে না, মৃত্যুরেকর্ড কিন্তু থাকে। গোরস্থানে থাকে। গোরস্থানের অফিসে কার কবর হলো তা লেখা। থাকবে।
আমাকে এখন গোরস্থানে গোরস্থানে ঘুরতে হবে?
মিসির আলি হাসতে হাসতে বললেন, অবশ্যই। আপনি একটা রহস্যের মীমাংসা করবেন, বিনা পরিশ্রমে তা কি হয়?