আমি বাচ্চাটার সুরতহাল করাতে পারতাম, তার জন্যে পুলিশ কেইস করতে হতো। সেটা করা সম্ভব ছিল না। আমার নিজের মাথাও তখন পুরোপুরি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। চোখ বন্ধ করলেই দেখতাম আমার ছোট্ট বাবু হামাগুড়ি দিয়ে আমার দিকে আসছে। তার সব ঠিক আছে হাসি হাসি মুখ, বড় বড় মায়াভর্তি চোখ; শুধু মুখ দিয়ে টপটপ করে। রক্তের ফোঁটা পড়ছে। দীর্ঘদিন গুলশানের এক মনোরোগ ক্লিনিকে আমাকে কাটাতে হয়েছে। সেখানেই আমি একবার ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুইসাইডের চেষ্টা করি।
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। আমার শাশুড়ি মারা গেছেন। স্বাভাবিক মৃত্যু। ডায়রিয়া হয়ে মহাখালী কলেরা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন। কিন্তু মৃত্যুর পরও তিনি আমার স্বামীকে ছাড়েন নি। এখনো হারুনের ঘাড়ে ভর করে আছেন। তিনি হারুনকে কন্ট্রোল করে যাচ্ছেন। হারুন তার জীবিত মায়ের দ্বারা যেভাবে চালিত হতো, মৃত মাও তাকে সেভাবেই চালিত করছে।
আমাদের আর কোনো ছেলেমেয়ে হয় নি। কারণ আমার শাশুড়ি তাঁর অতি আদরের ছেলেকে বলেছেন যেন আমার সঙ্গে কোনো শারীরিক সম্পর্ক না হয়।
আমি আপনাকে লেখা। আমার এই দীর্ঘ চিঠি এখানে শেষ করছি। আপনাকে ‘বাবা’ সম্বোধন করেছি যেন আপনি চিঠির এক কন্যার প্রতি দয়া করেন এবং চিঠি-কন্যার পুত্রের মৃত্যুরহস্য বের করেন। আমার ধারণা এই রহস্য ভেদ হওয়া মাত্র হারুনের মোহমুক্তি ঘটবে। সে তার মৃত মা’কে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলবে। আমি হারুনকে নিয়ে। সত্যিকার সংসার শুরু করতে পারব।
বিনীতা
চিঠিকন্যা শায়লা
মানুষের গল্প বলার Style
(লেখকের কথা)
একেকজন মানুষের গল্প বলার Style একেক রকম। অতি সাধারণ কথা মিসির আলি যখন বলেন তখন মনে হয় দারুণ রহস্যময় কোনোকিছুর বর্ণনা দিচ্ছেন। উদাহরণ দেই— একদিন তাঁর বাসায় গেছি। তিনি জানালার পাশে বসে গল্প করছেন। গল্পের এক পর্যায়ে বললেন ‘বুঝলেন ভাই! তখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি এত্ত বড় একটা চাঁদ। শুনে আমার গা ছমছম করে উঠল। আমি চমকে মিসির আলির জানালা দিয়ে তাকলাম। অথচ চমকাবার কিছু নেই। পূর্ণিমার রাতে জানালা দিয়ে এত্ত বড় চাঁদ দেখা যেতেই পারে।
এই তিনিই আবার অতি ভয়ঙ্কর ব্যাপার এমন সাদামাটাভাবে বলেন যেন এটা কিছুই না। এরকম রোজই ঘটছে। এক সিরিয়েল কিলার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে হাই তুলতে তুলতে বললেন ‘লোকটার অভ্যাস ছিল খেজুরের কাঁটা দিয়ে ভিকটিমের চোখ গেলে দেয়া। তাঁর বলার ভঙ্গি, বলতে বলতে হাই তোলা থেকে শ্রোতাদের ধারণা হবে খেজুরের কাঁটা দিয়ে চোখ তোলা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এমন কিছু না।
আমি অনেকদিন থেকেই মিসির আলিকে বলছিলাম, তাঁর রহস্য সমাধানের প্রক্রিয়ায় খুব কাছ থেকে আমি যুক্ত হতে চাই। আমি দেখতে চাই তিনি কাজটা কীভাবে করেন। লজিকের সিঁড়ি কীভাবে পাতেন। রহস্যের প্রতি আমার আগ্রহ না। আমার আগ্রহ রহস্যভেদ প্রক্রিয়ার প্রতি। সুযোগ সে অর্থে আসে নি। আমি নিজে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকি, মিসির আলি ঘরকুনো মানুষ। তিনি নিজেও তাঁর মানসিক জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের দু’জনের দেখা হয় না বললেই হয়।
এই সময় আমি আমার পারিবারিক ট্র্যাজেডির নায়ক হয়ে বসলাম। সমাজের একজন দুষ্ট মানুষ হিসেবে আমার পরিচয় ঘটল এবং মিটিং করে নিজের বাড়ি থেকে বের করে। দেয়া হলো। পত্র-পত্রিকাগুলিতে ছাপার মতো খবর অনেক দিন ছিল না। তারা মনের আনন্দে আমাকে নিয়ে নানান গল্প ফাঁদতে লাগল। মিসির আলি সাহেবের যে গল্পটি এখানে লিখছি, সেখানে আমার ব্যক্তিগত গল্পের স্থান নেই বলেই নিজের গল্প বাদ থাকল। অন্য কোনোদিন সেই গল্প বলা হবে।
যাই হোক, আমি বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে কিছুদিন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করলাম। বন্ধু-বান্ধবরা তেমন আগ্রহ দেখাল না। ‘মহাবিপদ’ কে সেধে পুষতে চায়? বাধ্য হয়ে উত্তরায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করলাম। তিনতলায় একা থাকি। দিনেরবেলা অফিসের একজন পিয়ন থাকে। হোটেল থেকে খাবার এনে দিয়ে সন্ধ্যায় নিজের বাসায় চলে যায়। আমি তাকে চক্ষুলজ্জায় বলতে পারি না যে তুমি। থাকো। এত বড় ফ্ল্যাটে একা থাকতে ভয় পাই।
ভয় পাওয়ার কারণ হচ্ছে, আমি মোটামুটি নিশ্চিত ফ্ল্যাটে আমি একা থাকি না। আমার সঙ্গে বিদেহী কোনো আত্মাও থাকেন। তিনি গভীর রাতে কাঠের মেঝেতে হাঁটাহাঁটি করেন। শব্দ করে নিঃশ্বাস নেন। রান্নাঘরে পানির টেপ ছেড়ে হাতেমুখে পানি দেন। এক রাতের ঘটনা তো ভয়ঙ্কর। রাত তিনটা বাজে। বাথরুমে যাবার জন্যে বিছানা ছেড়ে নেমেছি, হঠাৎ দেখি ঘরের মধ্যে বেঁটে মতো এক ছায়া মূর্তি। সে আমার চোখের সামনে ঘরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় চলে গেল। আমি বিকট চিৎকার দিতে গিয়েও দিলাম না। চিঙ্কার দিয়ে তো লাভ নেই। যে বিদেহী আত্মা আমার সঙ্গে বাস করেন, তিনি ছাড়া আমার চিৎকার কেউ শুনবে না।
এরপর থেকে ঐ বাড়িতে রাত কাটানো আমার জন্যে বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। সন্ধ্যার পর প্রতিটি ঘরের বাতি জ্বালিয়ে রাখি। কারেন্ট চলে যেতে পারে এই ভয়ে সব ঘরেই চার্জার। আমার বালিশের নিচে থাকে। টৰ্চলাইট। হাতের কাছে টেবিলে দেয়াশলাই এবং মোমবাতি। লোহা সঙ্গে রাখলে ভূত আসে। না। আমার শোবার ঘরে এই কারণেই রট আয়রনের খাট কিনে সেট করা হলো। তারপরেও ভয় কাটে না। রাতগুলি বলতে গেলে জেগেই কাটাই।