মিসির : আমি খুব খুঁটিয়ে ওকে লক্ষ করি নি। তাঁর সোনাবাঁধানো তিনটা দাঁত দেখে বিস্মিত হয়েছি। এ-যুগে সোনা দিয়ে কেউ দাঁত বাঁধায় না।
ইন্সপেক্টর : উনি কি আপনাকে বললেন যে ওরা দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো? নাকি এও আপনার অনুমান?
মিসির আলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, অনুমান নয়, দেখলাম।
ইন্সপেক্টর সাহেব মুখ বিকৃত করলেন। মনে হচ্ছে মিসির আলির কোনো কথাই তিনি বিশ্বাস করছেন না। মিসির আলির কাছে মনে হল পুরো ব্যাপারটা জট পাকিয়ে যাচ্ছে। একবার জট পাকাতে শুরু করলে জট পাকানোর প্রক্রিয়া দ্রুত ঘটতে থাকে। মিসির আলি বললেন, ওসমান গনি যে আমার কাছে এসেছিলেন, এই তথ্য আপনি কোথায় পেলেন?
ইন্সপেক্টর রকিবউদ্দিন যন্ত্রের মতো বললেন, ওঁর লেখার টেবিলে আপনার লেখা একটা চিরকুট ছিল। আপনার ঠিকানাও সেই চিরকুটে লেখা দেখুন তো এই হাতের লেখাটি আপনার?
জ্বি, আমার।
চিরকুটে এই জাতীয় কথা আপনি কেন লিখলেন।
উনি লিখতে বললেন বলেই লিখলাম।
কেউ কিছু লিখতে বললেই আপনি লিখে দেন?
না, তা দিই না। তবে মানুষটা যদি উন্মাদ হয় এবং কিছু লিখে না-দিলে যদি তার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় না থাকে, তখন লিখে দিতে হয়। আমার পরিস্থিতিতে আপনি যদি পড়তেন তাহলে বুঝতেন।
আপনি বলতে চাচ্ছেন। ওসমান গনি একজন উন্মাদ?
মানসিকভাবে সুস্থ না তো বটেই।
ঠিক আছে। আপনি যা বলছেন লিখে নিচ্ছি এবং ধরে নিচ্ছি যা বলছেন সবই সত্য।
মিথ্যা বলার আমার কোনো কারণ নেই।
দেখুন মিসির আলি সাহেব, আমি সতের বছর ধরে পুলিশে চাকরি করছি। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কারণে মিথ্যা বলার চেয়ে অকারণে মিথ্যা বলতে মানুষ বেশি পছন্দ করে।
আপনার অবজারভেশন ঠিক আছে। রকিবউদ্দিন উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বললেন, এখন আপনি আমার সঙ্গে চলুন।
কোথায়?
ওসমান গনি সাহেবের ডেড বডি দেখবেন।
তার কি প্রয়োজন আছে? মৃত মানুষ দেখতে ভালো লাগে না।
মৃত মানুষ দেখতে কারোরই ভালো লাগে না। আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে বলছি-আপনি আসুন।
চলুন।
কিছুই মিলছে না। গুলশানের অভিজাত এলাকায় তেতিলা বাড়ি। বাড়ির সামনে বিশাল লন। ফোয়ারা আছে, মার্বেল পাথরের একটি শিশু ফোয়ারার মধ্যমণি! চারদিক থেকে তার গায়ে পানি এসে পড়ছে। বাড়ির সামনে কোনো ফুলের বাগান নেই। ঘাসে ঢাকা লন, ঢেউয়ের মতো উঁচুনিচু করা। মনে হয়, বাড়ির সামনে ঢেউ খেলছে। বাড়ির প্যাটার্নও জাহাজের মতো। ফুলের বাগান বাড়ির দুপাশে। দেশিফুলের প্রচুর গাছ।
মিসির আলিকে গেটের বাইরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হল। কড়া পুলিশ পাহারা। কেউ ভেতরে ঢুকতে পারছে না। রকিবউদ্দিন ভেতরে গেলেন। প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট পর ফিরে এসে মিসির আলিকে নিয়ে গেলেন। দোতলার ঘরে নিচু খাটের ওপর শোয়ানো। সাধারণত মারা-বাড়িতে হৈচৈ কান্নাকাটি হতে থাকে। এখানে তার কিছুই নেই। ঘরের এক কোণায় রাখা গদিআঁটা চেয়ারে একটি অল্পবয়সী মেয়ে পাথরের মতো মুখ করে বসে আছে। মেয়েটি একদৃষ্টিতে মৃতদেহটির তাকিয়ে আছে। মেয়েটির মাথার চুল খুব লম্বা। গায়ে উজ্জ্বল সবুজ রঙের শাড়ি। খাটের এক কোণায় যিনি বসে আছেন, তিনি সম্ভবত ডাক্তার। সাফারির পকেট থেকে ষ্টেথোসকোপের মাথা বের হয়ে আছে! মৃত মানুষদের জন্যে কোনো ডাক্তার প্রয়োজন হয় না। উনি কেন আছেন কে জানে। ঘরের ভেতর একজন পুলিশ অফিসার আছেন। তাঁকে একইসঙ্গে নাৰ্তাস এবং বিরক্ত মনে হচ্ছে। তিনি স্থির হয়ে এক সেকেন্ডও দাঁড়াচ্ছেন না।
সাধারণত মৃতদেহ চাদরে ঢাকা থাকে। এ—ক্ষেত্রে তা করা হয় নি। মৃতদেহের মুখের ওপর কোনো চাদর নেই। মিসির আলি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছেন। তাঁর বিস্মিত হবার সঙ্গত কারণ ছিল।
রকিবউদ্দিন বললেন, মিসির আলি সাহেব, ভালো করে দেখুন। উনিই কি আপনার কাছে গিয়েছিলেন?
না, উনি যান নি। দাঁত দেখার প্রয়োজন আছে?
না, দাঁত দেখার প্রয়োজন নেই। যিনি আমার কাছে গিয়েছিলেন, তিনি মোটাসোটা ধরনের খাটো মানুষ। গায়ের রঙ শ্যামলা।
আপনার কাছে গিয়েছিল, তিনি বলেছেন যে তাঁর নাম ওসমান গনি?
জ্বি।
গদিতে বসে থাকা মেয়েটি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এখানে এত কথা বলছেন কেন? কথা বলার জায়গার তো অভাব নেই।
রকিবউদ্দিন মিসির আলিকে সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে এলেন। মিসির আলি বললেন, আমি কি চলে যাব?
হ্যাঁ, চলে যাবেন। দরকার হলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
দরকার হবে বলে মনে করছেন?
রকিবউদ্দিন ভাবলেশহীন গলায় বললেন, বুঝতে পারছি না। এটা একটা সিম্পল কেইস অব সুইসাইড। বাথরুমের ভেতর তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ ছিল। পুলিশের উপস্থিতিতে দরজা ভাঙা হয়।
ও।
আত্মহত্যা সম্পর্কে একটা নোট রেখে গেলে আর কোনো সমস্যা ছিল না! নোটটোট নেই—উল্টো আপনার সম্পর্কে আজগুবি কিছু কথা লেখা।
আপনার তাহলে ধারণা হচ্ছে কথাগুলি আজগুবি?
হ্যাঁ, তাই ধারণা হচ্ছে। পয়সা বেশি হলে মানুষ কিছু-কিছু পাগলামি করে। এইসব কিছু করেছেন। একজন কাউকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। সে গিয়ে বলেছে তার নাম ওসমান গনি। হতে পারে না?
হ্যাঁ, হতে পারে।
আচ্ছা, আপনি চলে যান। প্রয়োজন হলে আবার যোগাযোগ করব। তবে প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। এটা একটা আত্মহত্যা। এ-ব্যাপারে সবাই স্যাটিসফায়েড। ফ্যামিলির তরফ থেকে তা-ই বলা হয়েছে।