মিসির আলি ঘরে ঢুকতে-চুকতে বললেন, এক ঘন্টার কথা বলেছিলাম, একটু দেরি হল।
ইন্সপেক্টর রকিবউদ্দিন গম্ভীর গলায় বললেন, আপনি এক ঘন্টা পঁচিশ মিনিট দেরি হল।
বোঝাই যাচ্ছে মানুষটি বিরক্ত। পুলিশের লোকদের বিরক্তি প্রকাশের ভঙ্গি অন্যদের মতো নয়। রকিবউদ্দিন তাঁর বিরক্তি প্ৰকাশ করছেন। ঘন-ঘন নিঃশ্বাস ফেলে। রকিবউদিনের সঙ্গে আরো একজনকে দেখা যাচ্ছে। সে মনে হচ্ছে পদমর্যাদায় ছোট। ঘরে আরো চেয়ার থাকতেও বসেছে মোড়ায়। তার হাতে কাগজ এবং কলম।
মিসির আলি বললেন, আপনারা কি চা খাবেন? চা করি?
চা খাব না। আপনি আমার সামনে বসুন। কথার জবাব দিন।
আসানী এমন ভঙ্গিতে কথা বলছেন যেন আমি একজন আসামী। আমি কি আসামী?
খুন যখন হয়, তখন খুনীর পরিচিত সবাইকেই আসামী ভেবে নিয়ে পুলিশ এগোয়।
ওসমান গনি খুন হয়েছেন?
আপনি প্রশ্ন করবেন না। প্রশ্ন করার কাজটা আমি করব। আপনি উত্তর দেবেন।
বেশ, প্রশ্ন করুন।
আপনি দাঁড়িয়ে না-থেকে আমার সামনের চেয়ারটায় বসুন।
চেয়ারে না-বসে আমি বরং খাটে বসি। পা তুলে বসা আমার অভ্যাস। আপনারা শোবার ঘরে চলে আসুন। আমি খাটে পা তুলে বসব, আপনারা চেয়ারে বসবেন।
রকিবউদ্দিন কঠিন মুখে বললেন, আমি অন্যের শোবার ঘরে ঢুকি না। কথাবার্তা যা হবার এখানেই হবে।
বেশ, প্রশ্ন করুন।
রকিবউদিনের সঙ্গের লোকটি খাতা এবং পেন্সিল হাতে তৈরি। মনে হচ্ছে শর্টহ্যাণ্ড-জানা কেউ। আজকালকার পুলিশদের সঙ্গে শর্টহ্যাণ্ড-জানা লোকজন হয়তো থাকে, মিসির আলি জানেন না! পুলিশের সঙ্গে তাঁর সে-রকম যোগাযোগ কখনো ছিল না। প্রশ্নোত্তর শুরু হল। প্রশ্নের ধারা দেখে মনে হচ্ছে রকিবউদ্দিন দীর্ঘ দেড় ঘন্টা বসেবসে সব প্রশ্ন সাজিয়ে রেখেছেন। কোনটির পর কোনটি করবেন তা-ও ঠিক করে রাখা। তবে প্রশ্নগুলির মধ্যে প্ৰাণ নেই। প্রতিটি প্রশ্ন একই ভঙ্গিতে করা হচ্ছে। স্বরের ওঠানামা নেই, রোবট-গন্ধী প্রশ্ন।
ইন্সপেক্টর : মিসির আলি সাহেব।
মিসির : জ্বি।
ইন্সপেক্টর : আপনি কী করেন?
মিসির : এক সময় অধ্যাপনা করতাম। এখন কিছু করি না।
ইন্সপেক্টর : কিছু না-করলে আপনার সংসার চলে কী করে?
মিসির : আমার সংসার নেই। একা মানুষ। কোনো-না-কোনোভাবে চলে যায়।
ইন্সপেক্টর : একা মানুষদেরও বেঁচে থাকার জন্যে টাকা লাগে। সেই টাকাটা আসে কেত্থেকে?
মিসির : গনির মৃত্যুর সঙ্গে আপনার এই প্রশ্নের কোনো সম্পর্ক ধরতে পারছি না।
ইন্সপেক্টর : আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দিন। আপনাকে সম্পর্ক খুঁজতে হবে না।
মিসির : বাজারে আমার লেখা কিছু বই আছে, পাঠ্য বই। বইগুলি থেকে রয়েলটি পাই।
ইন্সপেক্টর : বাড়ি ভাড়া কত দেন?
মিসির : আগে দিতাম পনের শ টাকা। ইলেকট্রিসিটি এবং পনিসহ। এখন কিছু দিতে হয় না।
ইন্সপেক্টর : দিতে হয় না কেন?
মিসির : বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের একটা সামান্য সমস্যার আমি সমাধান করেছিলাম। তারপর থেকে উনি ভাড়া নেন না।
ইন্সপেক্টর : কী সমস্যা?
মিসির : ভৌতিক সমস্যা। ওর বাড়িতে ভূতের উপদ্রব ছিল। সেই উপদ্রব দূর করেছি।
ইন্সপেক্টর : আপনি কি ভূতের ওঝা নাকি?
মিসির : আমি ভূতের ওঝা নই। অবশ্যি এক অর্থে ভূতের ওঝা বলতেও পারেন। কিছু মনে করবেন না। আপনার প্রশ্নের ধারা আমি বুঝতে পারছি না।
ইন্সপেক্টর : ওসমান গনি সাহেব কি মাঝে-মাঝে আপনাকে অর্থসাহায্য করতেন?
মিসির : না। গতকালই আমি তাঁকে প্রথম দেখি।
ইন্সপেক্টর : আপনি বলতে চাচ্ছেন যে উনি আপনার কাছে এসেছিলেন।
মিসির : জ্বি।
ইন্সপেক্টর : উনি কখন এসেছিলেন আপনার কাছে?
মিসির : উনি রাত আটটার সময় এসেছিলেন, সাড়ে নটায় চলে যান।
ইন্সপেক্টর : ওর সম্পর্কে আপনি কী জানেন?
মিসির :আমি কিছুই জানি না।
ইন্সপেক্টর : আপনি মিথ্যা কথা বললেন, কারণ উনি যে ব্যবসায়ী তা আপনি জানতেন। আপনার শোবার ঘরের বালিশের কাছে রাখা একটা খাতায় আপনি তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন।
মিসির : জেনে লিখি নি, অনুমান করে লিখেছি। আরেকটি কথা, খানিকক্ষণ আগে যে বললেন। আপনি কারোর শোবার ঘরে ঢোকেন না, তা ঠিক নয়। আপনি আমার অনুপস্থিতিতে আমার শোবার ঘরে ঢুকেছেন।
ইন্সপেক্টর : সন্দেহজনক জায়গায় অনুসন্ধান চালানোর অধিকার পুলিশের আছে।
মিসির : তার জন্যে সার্চ ওয়ারেন্ট লাগে। আপনার কি সার্চ ওয়ারেন্ট আছে?
ইন্সপেক্টর : মিসির আলি সাহেব, আমার সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। আমি কাঁচা কাজ কখনো করি না। দেখতে চান?
মিসির : দেখতে চাই না। বুঝতে পারছি আপনি সত্যি কথা বলছেন। আর কী জানতে চান বলুন।
ইন্সপেক্টর :ওসমান গনি সাহেব ঠিক কী কারণে এসেছিলেন?
মিসির : ঠিক কী কারণে এসেছিলেন তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। দুটো ছোট সাইজের ভূতের কথা বললেন, আমার কাছে মনে হল তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ।
ইন্সপেক্টর : আপনার ধারণা উনি মানসিক রুগী?
মিসির : আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই, তবে সম্ভাবনা অবশ্যই আছে।
ইন্সপেক্টর : তাঁর হত্যাকারীর নাম তিনি আপনাকে বলে গেছেন? সেই নাম বলুন।
মিসির : আপনার কথায় আমি বিস্মিত বোধ করছি। এ-ধরনের কোনো কথাই হয় নি। তা ছাড়া শুধু-শুধু তিনি আমাকে হত্যাকারীর নাম বলতে যাবেন কোন?
ইন্সপেক্টর : এটা আমাদেরও প্রশ্ন। আচ্ছা, উনি যখন কথা বলছিলেন, তখন কোনো বিশেষ কিছু কি আপনার নজরে পড়েছে?