তিনি হাতমুখ ধুলেন। কেরোসিন কুকারে চা বানিয়ে খেলেন। খানিকক্ষণ ফ্ৰীহ্যান্ড একসারসাইজ করলেন। এও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন পদ্ধতির অংশ। ডাক্তার বিশেষভাবে বলে দিয়েছেন। পাথরের মতো মুখ করে বলেছেন, মিসির আলি সাহেব, আপনার শরীরের কলকব্জা সবই নষ্ট হয়ে গেছে। এটা কি আপনি জানেন?
মিসির আলি হাসতে-হাসতে বললেন, জানি।
আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে চান, না এখনি মরে যেতে চান?
অল্প কিছুদিন বাঁচতে চাই।
কতদিন?
এই ধরুন। এক বৎসর।
মিসির আলি ভেবেছিলেন ডাক্তার বলবেন, এক বৎসর কেন? ডাক্তার সে-প্রশ্ন করলেন না, খসখস করে প্রেসক্রিপশনে একগাদা কথা লিখতে লাগলেন।
ভোরবেলা খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে পনের মিনিট ফ্রি-হ্যান্ড একসারসাইজ হচ্ছে তার একটি। একসারসাইজের পর এক ঘন্টা প্রাতঃভ্রমণের ব্যাপার আছে। ডাক্তার সাহেব লিখে দিয়েছেন–ঝড় হোক, টাইফুন হোক, ভূমিকম্প হোক-এক ঘন্টা হাঁটতেই হবে।
এখন ঝড়, টাইফুন বা ভূমিকম্প কোনোটাই হচ্ছে না। টিপটপ করে বৃষ্টি অবশ্য পড়ছে। সেই বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে বের হওয়া যায়। ছাতা মাথায় প্রাতঃভ্রমণ মন্দ নয়। সকালবেলা এই বেড়ানোটা তাঁর খারাপ লাগে না। বিচিত্র সব চরিত্র দেখা যায়। একদল মানুষ প্রাতঃভ্রমণকে প্রায় উপাসনার পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। উপাসনার যেমন কিছু নিয়ম আছে, এদেরও আছে। আরেক দল আছে খাদক জাতীয়। ভ্রমণের এক পর্যায়ে বিশাল টিফিন-ক্যারিয়ার খুলে হাউহাউ করে পরোটা-গোস্ত যেভাবে গিলতে থাকেন, তাতে মনে হয় তাঁদের সৃষ্টি করা হয়েছে খোলা মাঠে বসে গোস্ত-পরোটা খাবার জন্যে।
মিসির আলি বেরুবার মুখে বাধা পেলেন। গেটের কাছে আসতেই ত্রিশ-পয়ত্রিশ বছর বয়েসী এক ভদ্রলোক এসে শীতল গলায় বললেন, আপনি কি বেরুচ্ছেন?
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, হ্যাঁ।
কাল রাতে ওসমান গনি নামের কেউ কি আপনার কাছে এসেছিলেন?
এসেছিলেন।
ঐ বিষয়ে আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলব। আমি পুলিশের লোক! ইন্সপেক্টর অব পুলিশ। আমার নাম রকিবউদ্দিন।
মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, ওসমান গনি কি মারা গেছেন?
হ্যাঁ, মারা গেছেন। আপনি কী করে জানলেন?
অনুমান করেছি। আমার অনুমানশক্তি ভালো।
ভালো থাকাই ভালো। আসুন, কথা বলি। বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হোম মিনিষ্টার নিজেই ইন্টারেস্ট দেখিয়েছেন। বেশিক্ষণ আমি আপনাকে বিরক্ত করব না। প্ৰাথমিকভাবে আধা ঘন্টার মতো কথা বলব। পরে আবার আসব।
রকিবউদ্দিন সাহেব, এখন তো আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারব না। এখন মর্নিং-ওয়াকে যাচ্ছি। এক ঘন্টা মর্নিং-ওয়াক করব। আপনাকে এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে।
এক ঘন্টা অপেক্ষা করা সম্ভব নয়, আপনাকে এক্ষুণি কথা বলতে হবে।
এমন কোনো আইন কি আপনাদের আছে যে পুলিশ যখন কথা বলতে চাইবে তখনি কথা বলতে হবে?
আইনের বিষয় নয়, হোম মিনিষ্টার নিজে বলেছেন। তিনি বিষয়টায় খুব আগ্ৰহ দেখাচ্ছেন।
আমি এই মুহূর্তে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছি না। কাজেই আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। আমি আমার ঘরের চাবি দিয়ে দিচ্ছি, আপনি আমার ঘরে অপেক্ষা করতে পারেন। তবে আপনার যদি ধারণা হয়। আমি পালিয়ে যেতে পারি, তাহলে আপনি আমার সঙ্গেও আসতে পারেন।
ঠিক আছে, আমি অপেক্ষা করব। আপনি দেরি করবেন না। দিন, ঘরের চাবি দিন।
মিসির আলি চাবি দিয়ে গেট খুলে রওনা হলেন। রাস্তার মোড় পর্যন্ত গিয়ে একবার পিছনে ফিরলেন। ইন্সপেক্টর সাহেব আগের জায়গায় চাবি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোকের মুখ শ্রাবণ মাসের আকাশের চেয়েও মেঘলা।
বৃষ্টি জোরেসোরে পড়া শুরু করেছে। রাস্তায় নোংরা পানি। পায়ের গােড়ালি পর্যন্ত ময়লা পানিতে ডুবিয়ে প্রাতঃভ্রমণে যাবার কোনো মনে হয় না।–তবু মিসির আলি যাচ্ছেন। ঝড় হোক, টাইফুন হোক, ভূমিকম্প হোক।–তাঁকে এক ঘন্টা হাঁটতে হবে। সকালের খোলা হাওয়া গায়ে লাগাতে হবে। এক বৎসর তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে। দেখা যাক, ডাক্তারের উপদেশ মেনে কতদূর কি হয়।
আজ শরীর অন্যদিনের চেয়েও বেশি খারাপ লাগছে। চোখ জ্বালা করছে, কোনো কিছুর দিকেই বেশি সময় তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না। শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নষ্ট হতে শুরু করেছে। শুধু শরীর নয়-মূনও নুষ্ট হতে শুরু করেছে। ওসমান গনির মৃত্যুসংবাদ তাঁকে বিচলিত করে নি; করা উচিত ছিল। খ্রিষ্টানরা মৃত্যুসংবাদে গির্জায় ঢং-টং করে ঘন্টা বাজায়। নিয়মটা সুন্দর। সবাইকে জানিয়ে দেয়া-শোন, তোমরা শোন! তোমাদের একজন চলে গিয়েছে।–ঢং ঢং ঢং, . . . . .
কেমন আছেন মিসির আলি সাহেব?
মিসির আলি তাকালেন–অপরিচিত একজন মানুষ। অপরিচিত মানুষদের প্রশ্নের জবাব খুব অল্প কথায় দিতে হয়, কিন্তু মিসির আলি একটি দীর্ঘ বাক্য বললেন, আমি ভালো না। শরীর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে-মলাও নষ্ট হচ্ছে। অপেক্ষা করছি ঘন্টার জন্যে, ঢং ঢং ঢং। ভাই যাই।
অপরিচিত ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তিনি এতটা অবাক হচ্ছেন কেন তাও মিসির আলি ধরতে পারলেন না।
পুলিশের লোকদের বিব্রত
পুলিশের লোকদের বিব্রত করে সবাই বোধহয় এক ধরনের আনন্দ পায়। এক ঘন্টার জায়গায় মিসির আলি দু ঘন্টা দেরি করে ফেললেন! ভ্রমণ শেষ করে হোটেল রহমানিয়ায় নাশতা করলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কটা পত্রিকা পড়লেন। গুরুত্বপূর্ণ মৃত্যুর কথা খবরের কাগজে থাকবেই। ওসমান গনি সম্পর্কিত কোনো খবর কোনো পত্রিকাতেই নেই। হোম মিনিষ্টারের কাছে মানুষটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও খবরের কাগজের লোকদের কাছে হয়তো নয়। হোটেল রহমানিয়া থেকে বের হয়ে তিনি নিতান্তই অকারণে নিউমার্কেটকীচা-বাজারে গেলেন। ভোরবেলা এখানে মাছের পাইকারি কেনা— বেচা হয়। গাদাগাদি করে রাখা মাছের স্তুপ হাঁকডাক হয়ে বিক্রি হয়। যারা কেনে, তারা মুখ কালো করে কেনে, যারা বিক্রি করে তারাও মুখ কালো করে বিক্রি করে। দেখতে মজা লাগে।