এখন হত্যার মোটিভে আসি। মোটিভ জটিল নয়, সহজ। পরিবারের তিন সদস্যের দু জন শেষ, একজন বাকি। সেই একজন শেষ হলে–বিপুল সম্পত্তি চলে যাবে আব্দুল মজিদ এবং তার মার হাতে। কারণ এরাই ওসমান গনির নিকট আত্মীয়। আমার যা বলার আমি বলেছি। আপনাদের কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।
কেউ কোনো প্রশ্ন করল না। মিসির আলি উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বললেন, আমি আমার নিজের আস্তানায় চলে যাব। আমার কাজ শেষ। নদিয়া, আপনি কি আপনার ড্রাইভারকে একটু বলে দেবেন আমাকে পৌঁছে দিতে?
নাদিয়া পাথরের মতো মুখ করে বসে আছেন। মনে হচ্ছে না, মিসির আলির কোনো কথা তিনি শুনতে পেয়েছেন। মিসির আলি আব্দুল মজিদের মার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার একটি কথা আমার খুব ভালো লেগেছে। আপনি বলেছিলেন, আল্লাহ্ বলেন, নিয়তিকে গালি দিও না, কারণ আমিই নিয়তি। এটা কোথায় আছে বলুন তো? কোন সূরা?
বৃদ্ধ জবাব দিলেন না। স্থির চোখে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে রইলেন। মিসির আলি বললেন, নাদিয়া বলছিলেন, আপনি নাকি খুব সুন্দর গল্প বলতে পারেন। আমার খুব ইচ্ছা একদিন এসে আপনার গল্প শুনি। যদি অনুমতি দেন একদিন এসে আপনার গল্প শুনব। আচ্ছা, আজ তাহলে যাই।
গাড়ি মিসির আলিকে নিয়ে রওনা হয়েছে। তিনি আশা করেছিলেন, এ-বাড়ি ছেড়ে রওনা হবার সময় নাদিয়া এসে বিদায় দেবেন। কিছু বলবেন নাদিয়া দোতলা থেকে নিচে নামেন নি। বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় এই মেয়েটির সুন্দর মুখ আরেক বার দেখতে ইচ্ছা করছিল। জানতে ইচ্ছা করছিল সবুজ শাড়ি এই মেয়েটির এত প্রিয় কেন। জানা গেল না।
মিসির আলি খুব ক্লান্ত বোধ করছেন। তাঁর অনেক দিনের সাথী তীব্র মাথার যন্ত্রণা আবার ফিরে এসেছে। চোখ জ্বালা করছে। তাকিয়ে থাকতে পারছেন না। গাড়ির সীটে হেলান দিয়ে তিনি চোখ বন্ধ করে আছেন। রহস্যের জট খোলার মধ্যে তীব্র আনন্দ আছে। সেই আনন্দ তিনি পাচ্ছেন না। কারণ রহস্যের একটি অংশের জুট তিনি খুলতে পারেন নি। একটি অংশ এখনো অমীমাংসিত। অম্বিকাবাবু কেন তাঁকে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়ালেন? তিনি কি আগাম জানতেন এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে? যদি জানতেন, তাহলে কীভাবে জেনেছেন? ওসমান গনির কথাবার্তা থেকে আঁচ করেছিলেন? তিনি কখনো ওসমান গনির বাসায় যেতেন না। দূর থেকে এত বড় একটি ঘটনা আঁচ করা কি সম্ভব? তাহলে কি তাঁর জ্যোতিষ শাস্ত্র তাঁকে সাহায্য করেছে? তা হয় না। জ্যোতিষ শাস্ত্র বলে কিছু নেই।
অম্বিকাবাবু কেন ওসমান গনির বাড়িতে কখনো যেতেন না? মিসির আলির মনে ক্ষীণ সন্দেহ-হয়তো—বা ওসমান গনির পালক পুত্রটি অম্বিকাবাবুর। তিনি তাঁর নিজের ছেলেকে এদের হাতে তুলে দেন। তা যদি হয়, তাহলে অম্বিকাবাবুর ওসমান গনির বাড়িতে না-যাওয়ার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। ব্যাখ্যাটি পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। অম্বিকাবাবু কেন তাঁর ছেলেকে দিয়ে দেবেন? এ-জাতীয় ঘটনা দরিদ্রদের মধ্যে ঘটে। অম্বিকাবাবু হতদরিদ্রের মধ্যে পড়েন না। তিনি একজন স্কুল শিক্ষক। তাছাড়া পুত্রের স্থান হিন্দুসমাজে অনেক ওপরে। মুখাগ্নিতে পুত্রের প্রয়োজন। মৃত্যুর পর পুত্রহীন পিতামাতার স্থান হয় পুন্নম নরকে। এমন অবস্থায় কেউ তার নিজের ছেলেকে দিয়ে দেবে, তা বিশ্বাস্য নয়। মিসির আলি আশা করেছিলেন গুলশান থানার ওসি সাহেব এ-ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করবেন। ছেলেটির অপঘাত মৃত্যুর পর নিশ্চয়ই থানায় জিডি। এটি করা হয়েছিল। সেখানে ছেলেটির সত্যিকার বাবার নাম থাকার কথা। কিন্তু ওসি সাহেব কোনো সাহায্য করতে পারেন নি। সতের বছরের পুরানো কাগজপত্র জোগাড় করা যায় নি। তবে এই রহস্যের সমাধান তেমন জটিল নয়। অম্বিকাবাবু এবং তাঁর কন্যাকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে। এমনও হতে পারে অম্বিকাবাবুর পুত্রের যখন ছমাস বয়স তখন তাঁর স্ত্রী মারা যান। ছোট্ট শিশুটিকে নিয়ে অম্বিকাবাবু খুবই বিব্রত বোধ করতে থাকেন … অতসীকে জিজ্ঞেস করলেই তো জানা যাবে কবে তার মা মারা গিয়েছেন। মিসির আলির কেন জানি জানতে ইচ্ছা করছে না। থাকুক না কিছু রহস্য অমীমাংসিত। প্রকৃতি সব রহস্য মানুষকে জানাতে চায় না। কিছু নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতে চায়। থাকুক না সেই সব রহস্য লুকানো। সব জানতেই হবে এমন কোনো কথা আছে?
সারা রাতের অনিদ্রা এবং ক্লাস্তির কারণেই হয়তো-বা মিসির আলির তন্দ্রার মতো হল। তন্দ্রার মধ্যেই তিনি একটা স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নে সাত-আট বছরের একটি বালককে দেখা গেল। বালকটি ছুটতে—ছুটতে তাঁর কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল। মিসির আলি বললেন, কিছু বলবে খোকা? ছেলেটি না-সূচক মাথা নাড়ল। স্বপ্নের মধ্যেই মিসির আলির মনে হল—এই সেই ছেলে-যে বাথরুমে কঠিন মৃত্যুকে গ্রহণ করেছে।
মিসির আলি বললেন, তুমি বাথরুমে মারা গিয়েছিলে, তাই না খোকা?
ছেলেটি হাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
বুঝলে খোকা–এ হচ্ছে নিয়তি। নিয়তিকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই–কারণ নিয়তি হচ্ছে ঈশ্বর স্বয়ং।
ছেলেটি আবার হাঁ-সূচক মাথা নাড়ুল। মিসির আলি বললেন, তুমি কিছু বলতে চাইলে বলতে পার।
ছেলেটি নিচু গলায় বলল, আপনি আমার বোনকে বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। আমি আপনার জন্যে উপহার নিয়ে এসেছি।
কী উপহোর?
তা বলব না।
ছেলেটি খুব হাসতে লাগল। মিসির আলির ঘুম ভেঙে গেল। অন্য যে-কেউ এই স্বপ্নে অভিভূত হত, মিসির আলি হলেন না। কারণ তিনি জানেন, উত্তপ্ত মস্তিকের কল্পনাই স্বপ্ন হিসেবে তাঁর কাছে এসেছে। এর বেশি কিছু না।