মিসির আলি বাগানে নেমে এসে বললেন, আমি আজ চলে যাব। আপনার বাড়িতে বেশ আনন্দে সময় কেটেছে। আপনাকে ধন্যবাদ।
নাদিয়া ভুরু কুঁচকে বললেন, আজ চলে যাবেন মানে? আপনি কি সমস্যার সমাধান করেছেন?
হ্যাঁ, করেছি। আপনি সকালে নাশতা খাবার সময় এ-বাড়িতে যারা উপস্থিত আছে সবাইকে ডাকুন, আমি সবার সামনে ব্যাখ্যা করব।
সবার সামনে ব্যাখ্যা করার দরকার কী? আমাকে বলুন।
আমি সবার সামনেই বলতে চাই।
নাদিয়া কিছুক্ষণ স্থির চোখে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। মিসির আলিও হাসলেন।
মেয়েটি আজও সবুজ শাড়ি পরেছে। মেয়েটি বোধহয় কালার-ব্লাইন্ড। একমাত্র কালার-ব্লাইণ্ডদেরই বিশেষ কোনো রঙের প্রতি দুর্বলতা থাকে। মিসির আলি বললেন, রবীন্দ্রনাথ যে কালার-ব্লাইন্ড ছিলেন তা কি আপনি জানেন?
না, জানি না। আপনার কাছে প্ৰথম শুনলাম।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কালার-ব্লাইন্ড। তিনি সবুজ রঙ দেখতে পেতেন না।
নাদিয়া বললেন, তাতে তাঁর সাহিত্যের বা গানের কোনো ক্ষতি হয় নি। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি হঠাৎ করে কালার-ব্লাইন্ডের প্রশ্ন তুললেন কেন?
এমনি তুললাম। কোনো কারণ নেই।
আপনি কি সত্যি-সত্যি রহস্যের মীমাংসা করেছেন?
মনে হয় করেছি।
মনে হয় বলছেন কেন? আপনি কি নিশ্চিত না?
না। প্রকৃতি মানুষকে Truth—কে স্পর্শ করার অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু Absolute truth-কে স্পর্শ করার অনুমতি দেয় নি। ঐটি প্রকৃতির রাজত্ব। মানুষের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই।
নীপবন থাকে শূন্য
বাড়ির সবাই এসেছে।
মিসির আলি তাদের চোখে মুখে কৌতূহল এবং সেইসঙ্গে চাপা উদ্বেগ লক্ষ্য করলেন। সবচেয়ে বেশি চিন্তিত মনে হচ্ছে সাফকাতকে। সে রীতিমতো ঘামছে। ঘনঘন ঢোক গিলছে। মিসির আলি কীভাবে শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না। নাদিয়া বললেন, বলুন কি বলবেন। চুপ করে আছেন কেন?
মিসির আলি সিগারেট ধরলেন। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে খানিকক্ষণ কেশে গলা পরিষ্কার করে শুরু করলেন–
কাল রাতে আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। আমার বাথরুমের দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাতি নিভে গিয়েছিল। আমি অশরীরী একটি কণ্ঠ শুনলাম! একটা বাচ্চা ছেলে-আমার নাম ধরে ডাকল। ফুলের গন্ধ পেলাম। আপনারা বুঝতেই পারছেন, ভয়াবহ ব্যাপার। আমি আতঙ্কে অস্থির হয়ে গেলাম। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি কিন্তু এ-জাতীয় একটি পরিস্থিতির জন্যে মনে-মনে তৈরি ছিলাম। আমি জানতাম একদিন-না-একদিন এ-রকম ঘটনা আমার ক্ষেত্রে ঘটবে। দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। বাতি নিভে যাবে। গলার আওয়াজ শুনব। ফুলের গন্ধ পাব। আমি খুব ভালোমতো জানতাম, পুরো ব্যাপারটা সাজানো। তার পরেও আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি।…
আমি আমার নিজের ভয় থেকেই পারছি, ওসমান গনি সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী কী পরিমাণ ভয় পেয়েছেন। তাঁর স্ত্রী সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, ওসমান গনি সাহেবকে এই অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল। আমার ধারণা, তিনি আমার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ভয় পেয়েছেন। কারণ তিনি জানেন না যে পুরো ব্যাপারটা সাজানো। তিনি ধরেই নিয়েছেন যা ঘটছে সবই সত্যি। একটা ভয়ংকর ভীতিক কাণ্ড তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। এর সঙ্গে তিনি জড়িয়েছেন একটি শিশুর অপমৃত্যু।
নাদিয়া মিসির আলিকে থামিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ গলায়, সাজানো ঘটনা কেন বলছেন? সাজানো ঘটনা বলার পিছনে আপনার যুক্তি কী?
যুক্তির অংশে যাবার আগে আপনি আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিন। আপনার বাবার মৃত্যু মৃত্যু বাথটাবে, তাই না?
হ্যাঁ।
কতটুকু পানি ছিল বাথটাবে?
অল্প পানি ছিল।
আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে -ঐ রাতে কলে পানি ছিল না?
আমার তেমন কিছু মনে পড়ছে না। পানি আছে কি না তা নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো মনের অবস্থা আমার ছিল না।
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বললেন, পানি না-থাকাটাই কিন্তু স্বাভাবিক। পানি থাকলে বাথটাব পানিতে পূৰ্ণ হয়ে যেত। দরজা ভেঙে বাথরুমে ঢুকলে আপনি দেখতেন তখনো কল দিয়ে পানি পড়ছে। আপনি নিশ্চয়ই তা দেখেন নি?
নাদিয়া বললেন, আমি এত কিছু লক্ষ করি নি। তবে বাথরুমে ঢুকে আমি কল দিয়ে পানি পড়তে দেখি নি। বাথরুমে পানি ছিল কি ছিল না, তা এত জরুরি কেন?
জরুরি কেন, বলছি।……
এক-এক করে বলি। ছোটবেলায় আমরা একধরনের খেলা খেলতাম। খেলার নাম টক্কা খেলা। পেঁপে গাছের পাতা দিয়ে খেলাটা খেলা হত। পেঁপে গাছের পাতার লম্বা ডাঁটাটা ফাঁপা। সেই ফাঁপা ডাঁটায় মুখ লাগিয়ে একজনের কানের কাছে ডাটার অন্য প্ৰান্ত নিয়ে বিকট চিৎকার করা–টক্কা টক্কা। এই হচ্ছে টক্কা খেলা শব্দ শুনে কিনে তাল লেগে যেত।……
পেঁপে পাতার ডাটা না নিয়ে একটা লম্বা নল যদি নেওয়া হয়, সেই নিলে মুখ লাগিয়ে কেউ কথা বললে, নলের অন্য প্রান্তে যে আছে সে কথা শুনবে। শব্দ প্রবাহিত হয় বায়ুর মাধ্যমে। নলের ভেতর আছে বায়ু!…….
এখন দেখা যাক বাথরুমে কী ঘটেছে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলি-দরজা আটকে যাবার কিছুক্ষণ পর আমি ঠিক আমার কানের কাছে একটা বাচ্চা ছেলের গলা শুনলাম। ভয়ংকর ব্যাপার তো বটেই। তবে ঘটনা কিন্তু সহজ। এক ধরনের টক্কা খেলা।
নাদিয়া তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, টিক্কা খেলা মানে?
মিসির আলি বললেন, বাচ্চা ছেলের প্রেতাত্মা আমার সঙ্গে কথা বলে নি। প্ৰেতাত্মা সেজে অন্য কেউ কথা বলেছে-খুব সম্ভব একটি মেয়ে কথা বলেছে। মেয়েদের গলার স্বর বাচ্চাদের মতো হাই পিচের হয়ে থাকে। সে কথা বলেছে। অন্য কোনো বাথরুমে বসে। বাথরুমের পানির ট্যাপের কাছে মুখ নিয়ে যেহেতু নালে কোনো পানি নেই, ফাঁপা নল, সেহেতু টক্কা খেলার মতোই শব্দ ভেসে এসেছে আমার বাথরুমে। এই হল ব্যাপার।