আমার খুব প্রয়োজন ছিল।
সতের বছর আগে কী ঘটেছিল তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। বর্তমানে কী ঘটছে তা নিয়ে মাথা ঘামান।
পাওয়া যাবে না বলছেন?
পাওয়া না-যাবারই কথা।
রেকর্ড নিশ্চয়ই কোথাও রাখা হয়।
তা রাখা হয়। ফাইলের গুদামে পড়ে থাকে। একসময় পোকায় কাটে। আমার ধারণা আপনি যে- রেকর্ডের কথা বলছেন তা এখন উই পোকার পেটে।
খুঁজে দেখবেন না?
উইপোকার পেট চিরে খুঁজতে বলছেন?
জ্বি-না–গুদামের কথা বলছি।
বললাম তো খোঁজ হচ্ছে।
তাহলে সন্ধ্যাকেলা একবার আসি?
ওসি সাহেব হতাশ গলায় বললেন, আসুন। শুধুসন্ধ্যায় না। রাতে একবার আসুন। মাঝরাতেও আসুন।
আপনি মনে হচ্ছে আমার ওপর বিরক্ত হচ্ছেন।
হ্যাঁ, হচ্ছি। পুলিশে কাজ করি বলে কি বিরক্তও হতে পারব না? অনেক আজব চিড়িয়া আমি আমার পুলিশী জীবনে দেখেছি, আপনার মতো দেখি নি।
আপনার বিরক্তি উৎপাদন করেছি বলে দুঃখিত।
শুধু বিরক্তি না ভাই, আপনি আরো অনেক জিনিস উৎপাদন করেছেন। তার মধ্যে রাগও আছে। নেহায়েত হোম ডিপার্টমেন্টের চিঠি আছে বলে কিছু বলি নি।
মিসির আলি হাসলেন। ওসি সাহেব তীব্রগলায় বললেন, হাসছেন কেন?
মিসির আলি বললেন, আর হাসব না। তবে আমি আসব। সন্ধ্যা সাতটার দিকে আসব।
ডাক্তার মুসফেকুর রহমান
ডাক্তার মুসফেকুর রহমান, (এম.আর. সি. পি., প্রফেসর, পিজি হাসপাতাল) ওসি সাহেবের মতোই বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। ডাক্তারদের সময়ের দাম আছে। সেই দামী সময়ের অংশ নিতান্ত অকারণে কাউকে দিয়ে দেওয়া যায় না। মুসফেকুর রহমান সাহেবের ধারণা, মিসির আলি নামের মানুষটি নিতান্ত অকারণে তাঁর সময় নিচ্ছে। তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া উচিত, কিন্তু দেওয়া যাচ্ছে না। সভ্যসমাজের অনেক অভিশাপের মধ্যে একটা অভিশাপ হচ্ছে—যা করতে ইচ্ছা করে, তা করা যায় না।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনাকে যা বলার তা তো বলেছি, তার পরেও বসে আছেন কেন?
এক্ষুণি চলে যাব। শুধু একটা জিনিস জানার বাকি, ওসমান গনি সাহেব কি কখনো কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গিয়েছিলেন?
আমি জানি না। আর জানলেও আপনাকে বলতাম না। ডাক্তারদের কিছু এথিকেল কোড় মানতে হয়। রুগীর রোগ সম্পর্কে অন্যকে কোনো তথ্য না-দেওয়া হচ্ছে তার মধ্যে একটি। কার কি অসুখ তা আমি অন্যদের বলব না।
কেন বলবেন না? ব্যাধি তো গোপন রাখার বিষয় নয়।
দেখুন মিসির আলি সাহেব, আমি বুঝতে পারছি আপনি মানুষটি তর্কে পটু। আমি আপনার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে যেতে চাচ্ছি না। ওসমান গনি সাহেবের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে তাঁর সম্পর্কে আমি যা জানি তা আপনাকে বলেছি। এর বেশি কিছু জানি না।
শেষের দিকে তিনি কোনো ধরনের হেলুসিনেশনে ভুগছিলেন কি?
আমার জানা নেই। একটু মনে করে দেখুন তো তিনি কি কখনো কথা প্রসঙ্গে আপনাকে বলেছেন যে তিনি তীব্র ভয় পাচ্ছেন বা এই জাতীয় কিছু?
হ্যাঁ, তা বলেছেন। বাথরুমে ঢুকলে তিনি ফিসফিস করে কথা শুনতে পান—যেন কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করে। বাচ্চা ছেলের গলা ছেলেটা তাঁর নাম ধরে ডাকত। দুঃস্বপ্ন দেখতেন। তিনি একবার জানতে চাইলেন কেন এ-রকম হচ্ছে।
উত্তরে আপনি তাঁকে কী বলেন?
আমি বলি যে অতিরিক্ত টেনশনে এ-রকম হতে পারে। আমি তাঁকে টেনশন কমাতে বলি। তাঁকে ঘুমের অষুধ দিই।
কী অষুধ দেন?
এটাও কি আপনার জানতে হবে?
হ্যাঁ, জানতে হবে। ডাক্তার সাহেব খসখস করে কাগজে অষুধের নাম লিখে মিসির আলির দিকে বাড়িয়ে দিলেন। শুকনো গলায় বললেন, এই অষুধটা দিই। আরো কিছু জানতে চান? এই অষুধ কীভাবে কাজ করে। কীভাবে নাৰ্ভ শান্ত করে-এ-জাতীয় কিছু?
না, আর কিছু জানতে চাই না। আপনাকে যথেষ্ট বিরক্ত করা হয়েছে। ধন্যবাদ।
মিসির আলি ঘর থেকে বেরুতে গিয়েও বেরুলেন না। আবার ফিরে এসে আগের জায়গায় বসলেন। ডাক্তার সাহেব কপাল কুচকে বললেন, কি হল?
একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছি। ওসমান গনি সাহেবের মেয়ে নাদিয়া গনি, সে কি কখনো তার বাবার মতো সমস্যা নিয়ে আপনার কাছে এসেছিল?
না, আসে নি। আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?
জ্বি, শেষ হয়েছে।
শেষ হয়ে থাকলে দয়া করে যান। দরজার কাছ থেকে আবার ফিরে আসবেন না।
হোম মিনিস্টার সাহেব
হোম মিনিস্টার সাহেব ফাইল থেকে মুখ না।–তুলেই বললেন, কেমন আছেন মিসির আলি সাহেব?
জ্বি ভালো!
ভালো থাকলেই ভালো। বসুন। হাতের কাজ শেষ হতে সময় লাগবে। আপনার যা বলার-এর মধ্যেই বলতে হবে। আপনি আবার ভেবে বসবেন না, এটাও আমার একধরনের ভান। বেশি-বেশি কাজ দেখাচ্ছি…
মিসির আলি বসলেন। মিনিস্টার সাহেব ফাইলে চোখ রেখে সহজ গলায় বললেন, খবরের কাগজ পড়েছেন?
জ্বি-না।
পড়লে একটা ইন্টারেষ্টিং খবর দেখতে পেতেন। আমার মন্ত্রিত্ব চলে যাচ্ছে–অন্য একজন আসছেন।
সত্যি নাকি?
না, সত্যি না। কিন্তু আমাদের দেশের লোকজন খবরের কাগজে যা পড়ে তা-ই বিশ্বাস করে। সবাই ঘটনা সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। যে-কারণে আজ আমার কাছে কোনো দর্শনাধী নেই। অন্যদিন ওয়েটিং রুম মানুষে গিজগিজ করত। আজ শুধু আপনি এসেছেন। খবরের কাগজ পড়েন নি বলে এসেছেন। পড়লে হয়তো আসতেন না। এখন বলুন কি ব্যাপার।
একটা পুরানো জিডি এন্ট্রি আমার দেখা দরকার। থানার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা বলেছে পাওয়া যাচ্ছে না।
কত দিনের পুরানো?
সতের বছর।