মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, আব্দুল মজিদ আপনার ছেলে?
হ্যাঁ বাবা। আমি জানি সে তোমাকে বলে নাই যে আমি তার মা। কাউকেই বলে না। বাপ-মার পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। আমার ছেলেটা ভালো, তবে বোকা ধরনের। বোকা বলেই ভালো। বয়স তো আমার কম হয় নাই। আমি দেখেছি। এই জগতে বোকারাই ভালো।
বোকা বলছেন কেন? আমার কাছে তো বোকা মনে হয় না।
তুমি দূর থেকে দেখেছ, এই জন্যে তোমার কাছে বোকা মনে হয় না। আসলে বোকা।
এই বাড়িতে একটা বাচ্চা ছেলে মারা গিয়েছিল, আপনার মনে আছে?
হ্যাঁ, মনে আছে।
কি ব্যাপার বলুন তো।
ঐ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না বাবা। ঐটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। এই দুনিয়ায় অ্যাকসিডেন্ট তো হয়। ছেলের নিয়তি ছিল ভয় পেয়ে মৃত্যু-তাই হয়েছে। নিয়তিকে গালাগাল দিয়ে তো লাভ নাই। কারণ আল্লাহপাক বলেছেন—নিয়তিকে গালি দিও না, কারণ আমিই নিয়তি।
পরবর্তী সময়ে যে দেখা গেল বাথরুম আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায়, এই সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
মনের ভুল। দরজা হয়তো একটু শক্ত হয়ে লাগে। এম্নি ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করে। কথায় আছে না-বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়? মনের বাঘটাই বড়।
আপনার বেলায় কখনো এই জাতীয় কিছু ঘটে নি?
না।
সালেহ, ঐ মেয়েটির কি এ-রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে?
একবার নাকি হয়েছে। চিৎকার, হৈচৈ। বাথরুমের দরজা ভেতর থেকে খুলতে পারে না। আমি হুইল চেয়ারে করে গেলাম। ধাক্কা দিতেই দরজা খুলল। দরজা খুলে দেখি অচেতন হয়ে পড়ে আছে। দাঁতে-দাঁতে লেগে জিহ্বা কেটে বিশ্ৰী অবস্থা! ঐ যে বললাম মনের বাঘ। তাকেও ধরেছে মনের বাঘে তুমি কি নিজে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতে চাও?
না, চাই না।
না-চাওয়াই ভালো। জিজ্ঞেস করার আসলে কিছু নাই। ভয় পাওয়া এই বাড়ির মানুষের একটা রোগ হয়ে গেছে।
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখা হল নাদিয়ার সঙ্গে। তিনি আজও টিয়াপাখি রঙের একটা শাড়ি পরেছেন। সবুজ রঙের প্রতি এই মেয়েটির খুব দুর্বলতা। নাদিয়া থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, তদন্ত এগুচ্ছে?
হ্যাঁ, এগুচ্ছে।
আমার ফুপুর সঙ্গে কথা বলে এলেন?
হ্যাঁ। উনি আপনার কেমন ফুপু?
সম্পর্ক বেশ দূরের, তবের দূরের হলেও নিকট আত্মীয় বলতে উনিই আছেন।
আপনাকে খুব স্নেহ করেন বলে মনে হল।
তা করেন। বেশ স্নেহ করেন। উনি আবার খুব চমৎকার গল্প বলতে পারেন। আমি এত সুন্দর করে গল্প বলতে কাউকে শুনি নি। আপনার তদন্তের ঝামেলা শেষ হলে একবার ওর গল্প শুনে যাবেন।
তাঁর ছেলেটি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
আব্দুল মজিদের কথা বলছেন? বিরাট বোকা। সে বয়সে আমার বড়, কিন্তু প্রতি ঈদে সেজেগুজে এসে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করবে। ও আপনার খাতির-যত্ন করছে তো? আপনার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছি ওর ওপর।
ও যত্ন করছে। ভালোই যত্ন করছে।
বাড়াবাড়ি রকমের যত্ন দিয়ে সে যদি আপনাকে বিরক্ত করে আমাকে বলবেন। আমি ধমক দিয়ে দেব ও নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু-কিছু কাজ করে, যা সহ্য করা যায় না। একবার কী করেছে শুনুন—কোথেকে এক মৌলানা সাহেবকে ধরে নিয়ে এসেছে। মৌলানা সাহেব নাকি দোয়া পড়ে এই বাড়ির জিন তাড়াবেন! লম্বা কোর্তা পরা মৌলানা। প্রতিটি বাথরুমে ঢুকছে আর কি দোয়—কালোম পড়ছে। দেখুন তো কী অস্বস্তিকর অবস্থা। বাথরুম কি দোয়া পড়ার জায়গা? আচ্ছা যাই, পরে কথা হবে। আপনার তদন্ত শেষ হতে কতদিন লাগবে?
বেশিদিন লাগবে না। প্রায় শেষ করে এনেছি।
তদন্ত শেষ হলে আবার নিজের আস্তানায় ফিরে যাবেন?
তা তো বটেই।
নাদিয়া হাসতে-হাসতে বললেন, আপনি ইচ্ছা করলে কিন্তু তদন্ত শেষ হবারচ পরেও আমার এখানে থেকে যেতে পারেন। আপনাকে কেন জানি না আমার পছন্দ হয়েছে। কী কারণে পছন্দ হয়েছে তা অবশ্যি আমি নিজেও ধরতে পারছি না।
নাদিয়া সিড়ি বেয়ে উঠে গেলেন। মেয়েটির চেহারায় আচার-আচরণে মিসির আলি শোকের কোনো ছাপ দেখলেন না। পিতার মৃত্যুশোক সে কাটিয়ে উঠেছে। মনে হয় ভালোভাবেই কাটিয়েছে।
গুলশান থানার ওসি
গুলশান থানার ওসি বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনি তাঁর ওসি জীবনে এত বিরক্ত চোখে বোধহয় কারো দিকে তাকান নি। ওসি সাহেবের ঠিক সামনের চেয়ারে মিসির আলি বসে আছেন। মিসির আলি কয়েকবার খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন। ওসি সাহেব পাত্তা দিলেন না। পাত্তা দেবার কথাও না। মিসির আলি নামের এই মানুষটি তাঁর সারাটা দিন নষ্ট করেছে। সকাল নটার সময় এসেছে, এখন বাজছে একটা। যাবার নাম নেই। চুপচাপ চেয়ারে পা তুলে বসে আছে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা কিছুই বোধ-হয় মানুষটির নেই।
ওসি সাহেব হাই তুলতে-তুলতে বললেন, আজ চলে যান মিসির আলি সাহেব। আজ আর হবে না। দীর্ঘদিন আগের ব্যাপার। পুরানো রেকর্ডপত্র কোথায় আছে কে জানে। সতের বছর তো অল্প সময় নয়।
মিসির আলি বললেন, আমি বরং সন্ধ্যার দিকে একবার আসি।
সন্ধ্যার দিকে আসার দরকার নেই। সামনের সপ্তাহে খোঁজ নিয়ে যাবেন।
তথ্যটা জানা আমার খুব দরকার। সতের বছর আগে বাথরুমে অল্পবয়সী একটা ছেলে মারা গিয়েছিল। এই বিষয়ে থানায় কোনো জিডি এন্ট্রি করা হয়েছে কিনা, পোষ্ট মার্টেম হয়েছে কি না, হয়ে থাকলে তার রিপোর্ট….
ওসি সাহেব অসহিষ্ণু গলায় বললেন, মিসির আলি সাহেব, দেশটা বিলেত-আমেরিকা না–বাংলাদেশ। এই দেশে এক সপ্তাহ আগের জিনিসই পাওয়া যায় না। আপনি এসেছেন সতের বছর আগের ব্যাপার নিয়ে।