আব্দুল মজিদ মাথা চুলকাতে—চুলকাতে বলল, আপাকে এটা না বললে খুব ভালো হয় স্যার। আপা শুনলে খুব রাগ করবেন।
আমি কাউকে কিছু বলব না।
আপনার কি পান খাওয়ার অভ্যাস আছে স্যার? পান নিয়ে আসব?
আন, পান আন। তবে জর্দা দিও না। আমি জর্দা খাই না।
রাত এগারটায় মিসির আলির যাবার কথা। তিনি বারটা পৰ্যন্ত জেগে রইলেন। বাথরুমের দরজার ব্যাপারটা করার জন্যে। বারটা দশমিনিটে বাথরুমে ঢুকলেন। দরজা বন্ধ করলেন। যথা সময়ে বের হয়ে এলেন। দরজা খুলতে কোনো সমস্যা হল না। তবে রাতে তাঁর ভালো ঘুম হল না। অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। বারবার ঘুম ভেঙে গেল। দুঃস্বপূও দেখলেন। সেই দুঃস্বপ্নে লম্বা একটা মানুষ এসে বলল, মিসির আলি সাহেব, আপনি সোনার দাঁত কিনবেন? আমার কাছে সোনার দাঁত আছে। খাঁটি সোনা। মিসির আলি বললেন, না, আমি সোনার দাঁত কিনব না।
আপনাকে স্যার কিনতেই হবে। এই কে আছিস, স্যারের কয়েকটা দাঁত টেনে তুলে ফেল। দেখি দাঁত না কিনে স্যার যায় কোথায়।
লোকটির কথা শেষ হতেই বাথরুমের দরজা খুলে সাঁড়াশি হাতে একটা ভয়ংকরদর্শন মানুষ বের হল। মিসির আলি ছুটছেন। লোকটাও সাঁড়াশি হাতে পিছনে পিছনে ছুটছে।
রাত তিনটার দিকে ঘুমের আশা ছেড়ে দিয়ে বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসলেন। তাঁকে থাকতে দেওয়া হয়েছে একতলায়। দোতলায় পায়ের শব্দ হচ্ছে। চটির ফটফট শব্দ আসছে। কেউ একজন বারান্দায় এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যাচ্ছে এবং আসছে। নিশ্চয়ই নাদিয়া।
কড়া নাড়তেই দরজা খুলল
কড়া নাড়তেই দরজা খুলল।
অতসী মুখ বের করল। মিসির আলি বললেন, ভালো আছ অতসী? অতসী স্থির চোখে তাকিয়ে রইল।
তোমার বাবা বাসায় আছেন তো? অতসী জবাব দিল না। মিসির আলি বললেন, আমি ভেবেছিলাম তোমরা আসবে আমার কাছে। তোমরা এলে না। শেষে নিজেই এলাম। ঠিকানা বদলেছ, খুঁজে বের করতে কিছু সময় লেগেছে। আজ কি তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করা যাবে? না আজও যাবে না?
যাবে।
তাহলে দরজা থেকে সরে দাঁড়াও। ঘরে ঢুকি।
অতসী দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। মিসির আলি বললেন, তুমি কি আমাকে দেখে অবাক হয়েছ? অতসী নিচু গলায় বলল, না, অবাক হই নি। আপনি আসবেন আমি জানতাম। বসুন, বাবাকে ডেকে দিচ্ছি।
অতসী ভেতরে চলে গেল। অম্বিকাবাবু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঢুকলেন। লুঙ্গি পরা, খালি গা। কাঁধের ওপর ভেজা গামছা। তিনি অবাক হয়ে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মেয়ের মতো তিনিও পলক না- ফেলে তাকিয়ে থাকতে পারেন।
মিসির আলি বললেন, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না।
অম্বিকাবাবু বললেন, স্যার বসুন। আপনি মিসির আলি। আগেও একবার এসেছিলেন। আমার মেয়ে আমাকে বলেছে। কি ব্যাপার স্যার?
আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। আপনি বসুন। আমি বেশিক্ষণ আপনাকে বিরক্ত করব না।
অম্বিকাবাবু বসলেন। মনে হচ্ছে একটু ভয় পাচ্ছেন। বারবার ভেতরের দরজার দরজার দিকে তাকাচ্ছেন! মনে হচ্ছে তিনি চাচ্ছেন তাঁর মেয়ে এসে বসুক তাঁর কাছে।
অম্বিকাবাবু।
বলুন।
আপনি ওসমান গনিকে চেনেন, তাই না?
জ্বি, চিনি।
তিনি হাত দেখাবার জন্যে আপনার কাছে আসতেন?
জ্বি।
তাঁর স্ত্রীও কি এসেছিলেন?
এক দিন এসেছিলেন।
ওসমান গনি প্রায়ই আসতেন?
মাঝে-মাঝে আসতেন। উনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন।
উনি কি পামিস্ট্রি বিশ্বাস করতেন?
না। উনি নাস্তিক ধরনের মানুষ। কোনো কিছুই বিশ্বাস করতেন না।
আপনি তাঁর মেয়েটিকে চেনেন?
না।
কখনো দেখেন নি?
না।
অতসী বলছিল। আপনার শরীর খারাপ। কী রকম খারাপ?
আমার মানসিক কিছু সমস্যা আছে। মাঝে-মাঝে মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। তখন কি করি বা কি না করি কিছুই বলতে পারি না। কিছু মনেও থাকে না।
আপনি যে আমার কাছে গিয়েছিলেন তা মনে আছে?
জ্বি-না, মনে নেই। আমাকে কী বলেছিলেন–কিছুই মনে নেই?
না। স্যার, ঐ সময় আমার মাথার ঠিক ছিল না।
অতসী চা নিয়ে ঢুকল। আগের মতো দুধ-চিনি ছাড়া চা নয়। দুধ-চা। চায়ের সঙ্গে বিসকিট আছে। চানাচুর আছে। মনে হচ্ছে আগের হতদরিদ্র অবস্থা এরা কাটিয়ে উঠেছে।
অম্বিকাবাবু!
বলুন!
আপনি কি কখনো ওসমান গনি সাহেবের বাড়িতে গিয়েছেন?
না।
কখনো যান নি?
না।
উনি কখনো আপনাকে যেতে বলেন নি?
না।
অতসী দু কাপ চা এনেছিল। মিসির আলি তাঁর কাপ শেষ করলেন। কিন্তু অম্বিকাবাবু নিজের কাপ ছুঁয়েও দেখলেন না। তিনি সারাক্ষণ বসে রইলেন মাথা নিচু করে। তাঁর দৃষ্টি চায়ের কাপের দিকে।
ওসমান গনি যে মারা গেছেন তা কি আপনি জানেন?
জানি।
কীভাবে জানলেন? পত্রিকায় পড়েছেন?
অম্বিকাবাবু জবাব দিলেন না। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে লাগলেন।
উঠি অম্বিকাবাবু।
আচ্ছা।
আরেকদিন এসে আপনাকে হাত দেখিয়ে যাব।
অম্বিকাবাবু মৃদু গলায় বললেন, এখন আর হাত দেখতে পারি না। অসুখের পর ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।
তাহলে গল্প করার জন্যেই না-হয় আসব। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
অম্বিকাবাবু কিছু বললেন না। মিসির আলি রোজ ভিলায় ফিরে এলেন। রোজ ভিলা তাঁর কাছে এখন নিজের বাড়িঘরের মতোই লাগছে। অন্যের বাড়িতে থাকছেন, খাওয়াদাওয়া করছেন-এ নিয়ে কোনো রকম অস্বস্তি বোধ করছেন না। রোজ তিলায় আজ নিয়ে পঞ্চম দিন! এখন পর্যন্ত আব্দুল মজিদ ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলেন নি। যদিও এ-বাড়িতে বেশ কিছু মানুষ বাস করে। দু জন বাবুর্চি আছে। এক জন একতলায় থাকে। সে পুরুষ। নাম মকিম মিয়া। অন্যজন মহিলা-জাহানারা। সে থাকে দোতলায়। দোতলায় ওসমান গনি সাহেবের দূর সম্পর্কের এক ফুপূও থাকেন। আশির কাছাকাছি বয়স হুইল চেয়ারে করে মাঝেমধ্যে বারান্দায় আসেন। এই বৃদ্ধা মহিলার দেখাশোনা করার জন্যে অল্পবয়স্কা একটি মেয়ে আছে। সালেহা নাম।