আব্দুল মজিদ।
ঞ্জি স্যার।
ঘর খুব পছন্দ হয়েছে। এত সুন্দর করে সব সাজানো, কিন্তু কোনো আয়না নেই, ব্যাপারটা কি বলুন তো?
ড্রেসিং রুম স্যার আলাদা। আয়না ড্রেসিংরুমে।
মিসির আলির বিশ্বয়ের সীমা রইল না, যখন দেখলেন এই ঘরের সঙ্গে লাগোয়া দুটি ঘর আছে! একটি বসার ঘর, অন্যটি ড্রেসিং রুম। বসার ঘরে টেলিফোন এবং ছোট্ট টিভি সেট আছে।
স্যার, আপনার খাবার কি এইখানে দিয়ে যাব, না ডাইনিং টেবিলে গিয়ে খবেন?
এখানেই দিয়ে যাবেন।
ডিনার কখন দেব স্যার?
আমি একটু রাত করে খাই। দশটার দিকে।
জ্বি আচ্ছা স্যার। এখন কি চা দিয়ে যাব?
এক কাপ চ পেলে মন্দ হয় না। তার আগে আপনি আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিন।
স্যার, আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন।
আচ্ছা, তুমি করেই বলব। প্রশ্নের জবাব দিতে কি কোনো অসুবিধা আছে?
জ্বি-না স্যার, অসুবিধা নেই। আপা বলে দিয়েছেন আপনি যা জানতে চান তা যেন বলি।
আপা যদি বলত–ওঁর প্রশ্নের জবাব দিও না, তাহলে কি জবাব দিতে না?
মজিদ চুপ করে রইল। মিসির আলি বললেন, বস মজিদ।
মজিদ বলল, আমি বসব না স্যার। যা বলার দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই বলব।
বেশ, তাহলে প্রশ্ন করি। খুব সহজ প্রশ্ন। তুমি কতদিন এ-বাড়িতে আছ?
এগার বছর।
কাঁটায়—কাঁটায় এগার বছর, না একটু বেশি বা একটু কম?
এগার বছর এক মাস।
তোমার কাজ কী?
স্যারের একটা লাইব্রেরি আছে। মিউজিক লাইব্রেরি, গানের অ্যালবাম, ক্যাসেট, সিডি ক্যাসেটের লাইব্রেরি। আমি সেই লাইব্রেরি দেখাশোনা করি।
তোমার চাকরিজীবন কি এখানেই শুরু, না এর আগে কোথাও কাজ করেছ?
বিভিন্ন জায়গায় নানান ধরনের কাজ করেছি। রানা কনসট্রাকশান কোম্পানিতে ছিলাম প্লামিং মেকানিক সেখানে তিন বছর কাজ করি। তারপর স্যারের লাইব্রেরির দায়িত্ব নিই।
মিউজিক লাইব্রেরির জন্যে যখন আলাদা একজন লোক আছে, তখন নিশ্চয়ই ধরে নেওয়া যায় যে লাইব্রেরিটা ওসমান গনি সাহেবের অত্যন্ত প্রিয়।
জ্বি স্যার, খুবই প্রিয়।
তুমি যখন লাইব্রেরিতে থাক না, তখন কি এটা তালাবন্ধ থাকে?
জ্বি স্যার, তালাবন্ধ থাকে।
এই বাড়ির সব ঘরের জন্যে চাবি আছে–সেই চাবির গোছা কার কাছে থাকে?
স্যারের কাছে। তবে এই ঘরের চাবি আমার কাছে থাকে।
এখন ঐ চাবিগুলি কোথায়? লাইব্রেরি ঘরের ড্রয়ারে। এনে দেব স্যার?
না, আনতে হবে না। ওসমান গনি সাহেব যখন বাথরুমে আটকা পড়লেন, হৈচৈ হতে থাকে, তখন তুমি কোথায় ছিলে?
লাইব্রেরি ঘিরে।
হৈচৈ শুনে ছুটে গেলে?
জি না স্যার, আমি যাই নি। আমি কিছু বুঝতে পারি নি। লাইব্রেরি ঘরে আছে এয়ার কুলার। এই জন্যে দরজা-জানোলা বন্ধ থাকে। ঐ রাতে এয়ার কুলার চালু ছিল। দরজা-জানোলা ছিল বন্ধ। বাইরের কোনো শব্দ কানে আসে নি।
তুমি কখন জানতে পারলে?
ঘটনার দু ঘন্টা পর।
গভীর রাতে এতক্ষণ লাইব্রেরি ঘরে তুমি কী করছিলে?
গান শুনছিলাম স্যার।
তোমার পড়াশোনা কতদূর?
দু বছর আগে প্রাইভেটে বি এ পাস করেছি।
মিসির আলি কিছুটা বিব্রত বোধ করলেন। বি এ পাস একজন মধ্যবয়স্ক মানুষকে তুমি-তুমি করে বলা যায় না। বলা উচিত নয়। সবাইকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হয়। মিসির আলি আব্দুল মজিদের দিকে ভালো করে তাকালেন। বিশেষত্বহীন চেহারা। দাঁড়িয়ে আছে কুজো হয়ে। মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। চোয়াল নড়ছে। পান চিবুচ্ছে বোধহয়! জর্দার গন্ধ আসছে। মিসির আলি বললেন, ওসমান গনি সাহেবের স্ত্রীও তো বাথরুমে মারা যান, তাই না।
জ্বি।
একই বাথরুম?
জ্বি, একই বাথরুম।
তখন তুমি কোথায় ছিলে?
মিউজিক লাইব্রেরিতে ছিলাম।
জেগে ছিলে?
জ্বি, জেগে ছিলাম।
আব্দুল মজিদ কী-একটা বলতে গিয়েও বলল না। চুপ করে রইল। মিসির আলি বললেন, তুমি কী বলতে চাচ্ছ বল।
কিছু বলতে চাচ্ছি না। স্যার।
আচ্ছা, যাও।
যদি কিছু লাগে, কলিং বেল টিপবেন। আমি চলে আসব।
আমার কিছু লাগবে না।
চা কি স্যার দিয়ে যাব?
দিয়ে যাও।
আব্দুল মজিদ ঘর থেকে বের হয়েই চা নিয়ে এল। মনে হচ্ছে চা তৈরিই ছিল। মজিদ বলল, যদি কফি খেতে চান, কফিও দেওয়া যাবে। খুব ভালো ব্রেজিলিয়ান কফি আছে। পারকুলেটরে কফি তৈরি করা হয়। স্যার খুব পছন্দ করতেন।
আমি কফি পছন্দ করি না।
আব্দুল মজিদ আবারো কী যেন বলতে গেল। শেষ মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিল।
মিসির আলি বললেন, কিছু বলবে?
জ্বি-না স্যার?
বলতে ইচ্ছা করলে বলতে পায়।
কিছু বলতে চাই না স্যার।
রাতে মিসির আলি এক-এক ডিনার শেষ করলেন। খাবার নিয়ে এল আব্দুল মজিদ। মিসির আলির মনে হল, সে তাঁকে দেখছে ভীত চোখে। আড়— চোখে তাকাচ্ছে। চোখে চোখ পড়ামাত্র চোখ সরিয়ে নিচ্ছে।
আব্দুল মজিদ।
জ্বি স্যার!
তুমি আমাকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছ, বলে ফেল।
আব্দুল মজিদ মাথা নিচু করে নিচু গলায় বলল, রাত বারটার পর যদি বাথরুমে যান তাহলে বাথরুমের দরজা বন্ধ করবেন না।
কেন?
একটু অসুবিধা আছে স্যার।
কী অসুবিধা?
দরজা খোলা যায় না।
দরজা খোলা যায় না মানে?
ভৌতিক কিছু ব্যাপার আছে স্যার। আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না। দরজা আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায়। আর খোলে না।
মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, রাত বারটার পর বাথরুমে গেলে এবং দরজা বন্ধ করলে আপনা-আপনি দরজা বন্ধ হয়ে যায়?
সব সময় হয় না। স্যার, মাঝে-মাঝে হয়।
তোমার ধারণা, ব্যাপারটা ভৌতিক?
জ্বি স্যার।
আচ্ছা, আমি মনে রাখব। সাবধান করে দেবার জন্যে ধন্যবাদ।