না, পড়তে চাই না। চিঠি আপনার কাছে থাকুক। আমি বুঝতে পারছিনা, এখানে তদন্তের কী আছে। হাট ফোলিওরে যারা মারা যায়। তাদের সবার বেলাতেই কি তদন্ত হয়? সাধারণ একটি মৃত্যু……
মৃত্যু সাধারণ কি না এ-বিষয়ে আপনার নিজেরও কিন্তু সন্দেহ আছে। শুরুতে আপনি আমাকে বলেছিলেন, আপনার ধারণা এটা আত্মহত্যা।
আমি তখন গভীর শোকের মধ্যে ছিলাম। প্রবল শোকে মানুষের চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে যায়। সহজ জিনিসকে জটিল মনে হয়। এটাই স্বাভাবিক। আপনার কি তা মনে হয় না?
হ্যাঁ, মনে হয়! আপনি ঠিকই বলেছেন।
তার চেয়েও বড় কথা, বাবা মারা গেছেন। বাথরুমে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। পুলিশের উপস্থিতিতে দরজা ভাঙা হয়।
তাও জানি।।
তাহলে ঝামেলা করতে চাইছেন কেন?
আমি কোনো ঝামেলা করতে চাইছি না। ঝামেলা আমি একেবারেই পছন্দ করি না। আমি শুধু এ-বাড়ির মানুষদের কিছু প্রশ্ন করে চলে যাব। এক দিন, বড়জোর দু দিন লাগবে।
পুলিশের কী কারণে সন্দেহ হল যে বাবার মৃত্যু তদন্তযোগ্য একটি বিষয়?
পুলিশের সন্দেহ হয় নি। তারা ডাক্তারের সার্টিফিকেট মেনে নিয়েছে। সন্দেহটা হয়েছে আমার!
সন্দেহ হবার কারণ কী?
অনেক কারণ আছে।
একটা কারণ বলুন।
দরজা ভেঙে আপনার বাবাকে বের করতে হল, এটাই সন্দেহের প্রধান কারণ। আমি আপনাদের বাথরুম দেখেছি—
জাষ্টি এ মিনিট, বাথরুম কখন দেখলেন?
প্রথম যে-বার এ-বাড়িতে এসেছিলাম। আপনার বাবার ডেডবডি বিছানায় শোয়ানো, তখন ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমের দিকে তাকালাম–
মিসির আলি সাহেব, আপনার অবগতির জন্যে জানাচ্ছি যে, ঐ বাথরুমে বাবা মারা যান নি।
তাতে অসুবিধা নেই। একটা বাথরুম দেখে অন্য বাথরুমগুলি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। আমি বাথরুমের লকিং সিস্ট্রেম আগ্রহ নিয়ে দেখলাম। ভেতর থেকে লক করা যায়। একবার লক করলে বাইরে থেকে খোলা যায় না। তবে বাইরে থেকে চাবি দিয়ে খোলা যায় যায় না?
হ্যাঁ, যায়।
আপনার বাবার বাথরুম ছিল ভেতর থেকে তালাবন্ধ। খুব সহজেই বাইরে থেকে চাবি দিয়ে দরজাটা খোলা যেত। তা না-করে আপনারা পুলিশ ডেকে আনলেন।
নাদিয়া হেসে ফেললেন। তাঁর চোখে-মুখে এতক্ষণ যে কঠিন ভাব ছিল তা দূর হয়ে গেল। তিনি হালকা গলায় বললেন, নিন। মিসির আলি সাহেব, চা নিন। চা খেতেখেতে কথা বলি।
মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। নাদিয়া হাসিমুখে বললেন, আপনার কথা সত্যি। চাবি দিয়ে বাথরুমের দরজা খোলা যায়। এ-বাড়ির প্রতিটি দরজাই এ-রকম। এবাড়িতে বাথরুম নিয়ে ঘরের সংখ্যা হচ্ছে তেত্রিশ। তেত্রিশটি চাবির একটা বড় গোছা। কোনো চাবিতে নম্বর দেওয়া নেই। কারণ চাবিগুলি ব্যবহার করা হয় না। তেত্রিশটি চাবি থেকে একটা বাথরুমের চাবি অনুমানের ওপর বের করা অসম্ভব ব্যাপার। তা ছাড়া চাবির গোছা থাকে বাবার কাছে। তিনি তা কোথায় রেখেছেন তা আমাদের জানা নেই। এখন একজন বুদ্ধিমান লোক হিসেবে আপনি আমাকে বলুন, এই অবস্থায় আমাদের কী করা উচিত। চাবির গোছা খুঁজে বেড়ানো উচিত, না দরজা ভাঙা উচিত।
দরজা ভাঙা উচিত।
সেই কাজটিই আমরা করেছিলাম। আরেকটি কথা—পুলিশকে ডেকে এনে দরজা ভাঙা হয় নি। দরজা যখন ভাঙা হচ্ছে তখনই পুলিশ চলে আসে। সম্ভবত আপনার জানা নেই, দু জন পুলিশ সেন্ট্রি আমাদের বাড়ি পাহারা দেয়া হৈচৈ শুনে তারা নিচে থেকে ওপরে চলে আসে। আমার কথাগুলি কি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে?
জ্বি, মনে হচ্ছে।
এর পরেও আপনি তদন্ত চালিয়ে যেতে চান?
যদি আপনি অনুমতি দেন। তবেই তদন্ত চালাব।
আমি অনুমতি দিলাম। এ-বাড়িতে যারা আছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করুন। ঘুরেফিরে দেখুন। সবচেয়ে ভালো হয় কী করলে জানেন? সবচেয়ে ভালো হয় যদি আপনি অতিথি হিসেবে এ-বাড়িতে উঠে আসেন। যতদিন আপনার দরকার এবাড়িতেই থাকবেন। খাওয়াদাওয়া এখানে করবেন। তদন্তের কাজ শেষ হলে চলে যাবেন। এতে আমার নিজেরও সুবিধা হয়।
কি সুবিধা?
আপনার পাশাপাশি থেকে তদন্তের ধারাটা দেখতে পারি। বইপত্রে পড়েছি ডিটেকটিভরা কী করে খুনী পাকড়াও করে। বাস্তবে কখনো দেখি নি। আপনার কারণে সেই সুযোগ পাওয়া যাবে।
মিসির আলি বললেন, আপনার কী করে ধারণা হল যে আমি খুনী ধরতে এসেছি?
সঙ্গত কারণেই এ-ধারণা হয়েছে। স্বাভাবিক মৃত্যু কিংবা আত্মহত্যা-এই দু কারণে তদন্তের জন্যে বিশেষজ্ঞ আনা হয় না। খুনটুনি হলে তবেই বিশেষজ্ঞ আসে। আমি কি ভুল বলছি?
না, ভুল বলেন নি।
আপনি তাহলে আসছেন। এ-বাড়িতে?
জ্বি, আসছি।
তাহলে দেরি করবেন না। আজই চলে আসুন। দি আরলিয়ার দি বেটার।
এক সুটকেস বই এবং এক সুটকেস কাপড়চোপড় নিয়ে সন্ধ্যাবেলা মিসির আলি রোজ ভিলায় উঠে এলেন। আব্দুল মজিদ নামের মধ্যবয়স্ক এক লোক তাঁকে থাকার ঘর দেখিয়েদিল। বিরাট ঘর। অ্যাটাচিড বাথরুম। সেই বাথরুম ও বিশাল। বাথটাব আছে। ঠাণ্ডা পানি, গরম পানির ব্যবস্থা আছে। বাথরুমে যে—ব্যাপারটা তাকে সবচেয়ে বেশি মুকুল, তা হল বড় একটা ঘড়ি। এখন পর্যন্ত কোনো বাথরুমে তিনি ঘড়ি দেখেন নি।
ঘরের আসবাবপত্রে রুচির ছাপ স্পষ্ট। খাটের পাশে বেড়-সাইড কাপোর্ট। এক কোণায় জানালার পাশে লেখার টেবিল টেবিলে কাগজ, কলম, খাম, পোষ্টেজ স্ট্যাম্প থরেথরেসাজানো অন্য প্রান্তেবিরাট ওয়ার্ডড়োবা দেয়ালে রেনোয়ার দুটি ছবির প্রিন্ট। দুটিই অপূর্ব প্রিন্ট মনেই হয় না। ঘরে কোনো আয়না নেই-এই একমাত্র ত্রুটি।